শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫



গুরু কৃপা- একটি কাহিনী

[মাইজদী স্থিত জন্মোত্সব মন্দির থেকে প্রকাশিত শ্রীঠাকুরের ১২৫ তম শুভ আবির্ভাব তিথি স্মরণে এই কাহিনীটি মুদ্রিত হয়েছিল, হুবহু তাই প্রকাশ করা হলো।]
১৯৮১ সন। যাদবপুর কৈবল্যধাম প্রাঙ্গন।পশ্চিমবঙ্গ। নাম গ্রহণ অনুষ্ঠান। ভক্তবৃন্দের প্রচুর ভিড়। একে একে নাম গ্রহণ করে সানন্দে ভক্তবৃন্দ ঘরে ফিরে গেল। কিন্তু সর্বালঙ্কারে বিভূষিত চারুলোচনা এক মহিলা মন্দিরের এক কোনে প্রথম থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সবাই ঘরে ফিরল কিন্তু মহিলাটির মধ্যে সে তাগিদও অনুভূত হল না। মহারাজ (চতুর্থ মোহন্ত মহারাজ শ্রীমত ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়) ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছিলেন। আসন ত্যাগ করে মহারাজ উঠলেন স্বস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য। এমন সময় মহিলা এসে বললেন- বাবা, আমি আপনার কাছে কিছু কথা বলবো। শুনতে হবে। মহারাজ অভয় দিলেন। মহিলা তাঁর নিবেদন করলেন:
পাশাপাশি দু'টি গ্রাম। মাঝে ছোট একটি নদী। ওপারের গ্রামে রামসাধু এসেছেন। খবরটি বাতাসের আগে চারদিকে প্রচারিত হল। আমার শাশুড়ি দীর্ঘ দিন থেকেই ঠাকুরকে দেখা এবং ঠাকুরের কাছ থেকে নাম গ্রহণ করার জন্য আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু এবার সে সুযোগ পেয়েও তিনি বুঝি বঞ্চিত হবে। দারিদ্রই একমাত্র প্রতিবন্ধকতা। পরনে ছেঁড়া কাপড়। আর্থিক অসচ্ছ্বলতা। দিন আনে দিন খায়। কিন্তু নাম গ্রহনের চিন্তায় কাজে মন বসে না। প্রতিবেশীরা সবাই ঠাকুর দর্শনে ওপারে যায়। অপসৃয়মান দর্শনার্থী ভক্তদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শাশুড়ি চোখের জল ফেলেন। খেয়াপারের পয়সাটি পর্যন্ত তাঁর কাছে নেই।
এক অপরাহ্ন। ঐ নদীর তীর। দর্শনার্থী লোকজন দেখল কৃষ্ণকায় শান্ত সৌম্য এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মন এপারের খেয়াঘাটে নামলেন। এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। মাঝিকে সবাই জিজ্ঞেস করলো-ব্রাহ্মনটি কে?
মাঝি-শুনেছি রামসাধু।
আর যায় কোথায়! ভক্তবৃন্দ সাধুর পেছনে ছুটলো। সাধু বাবা এলেন আমাদের উঠোনে। আমার শাশুড়িকে ডেকে বললেন- মা, আমি নাম দিতে এসেছি। নাম গ্রহণ করুন। ছিন্নবসনা আমার শাশুড়ি, আটপৌরে পোশাকে দয়াল ঠাকুরের সামনে যেতে ইতস্ততঃ করছিলেন। ঠাকুর ঐ অবস্থাতেই নাম গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানালেন। শাশুড়ি ভক্তিভরে মন্ত্র গ্রহণ করলেন। ঠাকুর ফিরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় আমার শাশুড়ি করে বসলেন এক কাণ্ড। তিনি হঠাত করে ঠাকুরের শ্রীচরণ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- বাবা, এক বছর আগে আমার তিন বছরের একটি ছেলে মারা গেছে। আমাকে যখন এতই অনুগ্রহ করলেন, আমার সে ছেলেটিকেও আজ আমাকে ফিরিয়ে দিন। ঠাকুর তো অবাক! বলে কি! এ কি করে সম্ভব। কিন্তু কোন কথাতেই শাশুড়ি ঠাকুরের শ্রীচরণ ছেড়ে দিতে রাজি হলেন না। একটি মাত্র শর্ত। আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। ঠাকুর ক্ষনিকের জন্য যেন চিন্তা করলেন। তারপর শাশুড়িকে অভয় বাণী দিয়ে সেখানেই ধ্যানস্থ হলেন। দশনার্থী ভক্তবৃন্দ বাড়িময়। কিছুক্ষণ পর ঠাকুর বললেন- মা, অচিরেই তোমার হারানো ছেলে তোমার গর্ভে ফিরে আসবে। ঠাকুর স্বস্থানে ফিরে গেলেন। তিন বছর পর আমার শাশুড়ি হলেন সন্তানসম্ভবা। নির্দিষ্ট সময়ান্তে মায়ের কোল জুড়ে এলো একটি শিশু সন্তান। মুখে যেন তার স্বর্গীয় সুষমা। সেই চেহারা। সেই কান্তি। পার্থক্য কোথাও নেই। পূর্বের মৃত সন্তানই শাশুড়ির ঘর আলোকিত করে এলো।
আমি সেই পুত্রেরই বধূ। আজ আমাদের সব আছে। সব হয়েছে। আশির্বাদ করবেন আমরা যেন ঠাকুরের শ্রীচরণে আশ্রিত থাকি।
ঠাকুর প্রসঙ্গে এই ঘটনাটি আমাদের কাছে প্রকাশ করে মহারাজ বলেন- আমি এমনই দুর্ভাগা যে, মহিলাটির ঠিকানা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি।
যেই জন মনে প্রাণে ভজে রাম রাম।
ঘরে বসে পায় সে শ্রী কৈবল্যধাম।।

স্মরনিকা
চতুর্থ মহারাজ শ্রীমত ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়- এর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
পৃষ্ঠা: ৭

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন