ঠাকুরের পরীক্ষা
ঠাকুরের সর্বধর্ম সমন্বয়ে হিন্দু, মুসলমান,বৌদ্ধ, ঈশাই কোনো ধর্মের প্রতিই তাঁর অনীহা ছিল না, ছিল না কোনো বিদ্বেষ। কিন্তু ভিন্ন ধর্মালম্বীরা ঠাকুরের কাছে নাম নিতে এমনি এমনি ছুটে আসেনি। তারা ঠাকুরকে নিয়ে হাসাহাসি করতো কারণ ঠাকুরের ছিল না গেরুয়া বসন, ছিল না লোক দেখানো সাধন ভজন, ছিল না ভরং, ছিল না জনসমক্ষে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সামান্যতম প্রচেষ্টা। কেউ অবজ্ঞা করলে তিনি সেসব লোকের থেকে শতযোজন দুরে চলে গেছেন। মুহুর্তে আবার শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে ঠাকুরের আরাধনা, পূজা য়ারা করেছেন, ছুটে গেছেন তাদের কাছে। গুরু প্রসঙ্গ, আলোচনায় শ্রী হীরালাল সাহা বললেন- বাংলাদেশের দক্ষিনি মুসলমানরা হিন্দুদের 'মালায়ুম' বলে ডাকতো। শ্রীশ্রী রামঠাকুরের নাম কোনো আশ্রিত হিন্দু বললেই তারা তাচ্ছিল্য ভরেই বলতো- মালায়ুমরা তরার ঠাকুরকে পরীক্ষা করুম কত বড় ঠাকুর তাইন।
ঠিক আছে কইরা দেখ। তরার পরীক্ষার কথা ঠাকুর আগেই জানব। যাইতে ঠাকুরের পূজার জন্য কিছু একটা লইয়া যাইস বললেন চৌমুহনীর হীরালাল সাহা। একদিন চার মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত মানুষ চৌমুহনীর নরেন্দ্র ভুইঁয়ার টালির ঘরে ঠাকুরের পরীক্ষার জন্য উপস্থিত। ঘরে বহু আশ্রিত, নাম প্রার্থী ও ভক্তরা ঠাকুরের পাদস্পর্শে ধন্য হবার জন্য অপেক্ষারত। চার মুসলমানও সেই ভক্তদের মাঝে গিয়ে বসলেন। তাদের হাতে হাড়িতে করে নিয়ে আসা ভোজ্য নিবেদন করতে লাগলেন। শ্বেত পুষ্পবত পাদপদ্মে স্পর্শ করে প্রনাম করতেই ঠাকুর আশীর্বাদ শেষে বললেন- সবাইকে প্রসাদ দিয়া যান। সব্বার ক্ষেত্রে ঠাকুরের একই নির্দেশ। দর্শন ও স্পর্শেই ঠাকুরের ভোগ গ্রহণ। তাই প্রসাদ বিতরণের নির্দেশ। বারোটা বাজার কাছাকাছি। এতক্ষণে সমস্ত আশ্রিত ও শ্রদ্ধালুরা - গুরু প্রনাম জানিয়ে চলে গেছেন। চার মুসলমান পরীক্ষক তখনও ঠায় বসে। তাদের মনে শংকা। শ্রীশ্রী ঠাকুর তাদের দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে বললেন - ঠাকুরেরে ভোগ নিবেদন কইরা প্রসাদ লন। দেরী কইরেন না। ভোগের সময় বইয়া যায়।
ঠাকুরের আহ্বান শুনেও মুসলমান চারজন নিশ্চুপ। শুধু গুরুর মুখপানে তাকিয়ে আছেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর খুব কম কথা বলতেন তা সব্বারই জানা। তবু দিব্যদৃষ্টির প্রভাবে চার মুসলমানের মনের কথা জেনে আবার আহ্বান জানালেন- যা গুরুর নামে আনছেন তাই দেন। লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই।
এ যেন গুরুর তীক্ষ্ণ নির্দেশ। তারা চারজন তাদের হাতের পাত্রের মুখ খোলে তার ভিতরে হাত দিলেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বেশ বড় আকৃতির অনেক অনেক বাতাসা। সব্বার হাঁড়ি থেকে যেন অফুরন্ত বাতাসা বেরুচ্ছে। বিস্ময়ে হতবাক চার মুসলিম যুবক। কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে ঠাকুরের পায়ে ধরে কাদতে শুরু করলো। বলতে লাগলো ঠাকুর আমাদের অপরাধ মাপ কইরা দেন। আমরা না বুইঝা এত বড় পাপ করছি। আপনারে পরীক্ষা করতে আইছি। আমাদের পাপের সীমা নাই। আপনি আমরারে বাঁচান। ছি ছি আমরা নরাধম। আপনারে সন্দেহ করছি। .....বিলাপ আর কান্না তাদের আর থামে না। তাদের অশ্রু শ্রীশ্রী ঠাকুরের পাদপদ্মে বিগলিত ধারায় বইতে থাকে। ঠাকুর একে একে চারজনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন- জয় সত্যনারায়ণ, জয় সত্যনারায়ণ, সত্যের জয় সর্বত্র। সত্যরে ধৈরা পইরা থাকেন।
তারা কাতর কন্ঠে বললেন- ঠাকুর আমাদের নাম দেন। ঠাকুর আশীর্ব্বাদ ও বরাভয়ের ভঙ্গিতে- চারজনকেই নাম দিলেন। বললেন- নাম লইয়া স্বধর্মে পইরা থাকেন। ইসলাম ত্যাগ কইরেন না। নাম করলেই হয়। সর্বদা ধীর হইতে হয়। ধীরে অভ্যাসেই সংসার ত্রান পায় নামের অভ্যাস যোগে থাকিতে থাকিতে মনের গ্লানি দূর হইয়া দেহমন, চিত্ত, ভাব সকল পবিত্রতা লাভ করিয়া পরম শান্তি পাওয়া যায়। নামই চিন্তামনি। নামে বিশ্বাস রাইখেন।
ঠাকুরের চরণে মাথা রেখে চারজনই বললেন- ঠাকুর আমাদের মনের গ্লানি, অপরাধবোধ কীরূপে দূর হবে?
ঠাকুর পরমস্নেহে বললেন- জগতে কাহারো দোষ দেখিতে হয় না। সরলতা সহ নাম করিয়া যান। সরলতাই আনন্দ উত্পন্ন করিয়া লয়।
কী করেছিল ওই চার মুসলমান ঠাকুর পরীক্ষক? তারা গুরুকে পরীক্ষার জন্য হাঁড়িতে নিষিদ্ধ মাংস নিয়ে এসেছিল। কিন্তু গুরু কৃপায় তা বাতাসাতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। তাই ধন্য হয়ে চার উদ্ধত মুসলিম হয়ে যায় শ্রীশ্রী ঠাকুর অন্তপ্রাণ। সবই শ্রীগুরুর অপার মহিমা। অশীতিপর বৃদ্ধ হীরালাল সাহা ঠাকুরের ওই সব কথা বলতে বলতে আরও বললেন- আমার পরম সৌভাগ্য ঠাকুর দেহ রাখার পর সে পবিত্র দেহ স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ঠাকুর দক্ষিন বাজারের গৃহে রবিবারের দুপুর দেড়টায় দেহ রাখেন আর আমি দৌড়াইয়া গিয়া দেখি সব শেষ। আমার বুক ফাইট্টা যাইতে ছিল। তবু ঠাকুরের পটে তিনি আছেন ভাইবা মনে সান্ত্বনা পাইছি।
আচ্ছা চার মুসলমানের শিষ্যত্ব গ্রহনের ও গুরুরে পরীক্ষায় যে কথা কইলেন তাকি আপনে দেখছেন?
কী কইরা দেখুম? ঠাকুরতো সব্বাইরে বাইর কইরা দিয়া তার পরে তান বিভূতি দেখাইছেন। আমরা সব শুনছি ওই মুসলমান ভক্তদের কাছ থেইক্কা। তারা বাইচ্চা থাকা অবধি সত্যনারায়ণ দিত আর ঠাকুরের জন্মদিন ও বহু পূজা পার্বন ঠাকুরের নির্দেশে করত।
পরমেষ্ঠী গুরু শ্রীশ্রী রামঠাকুর
ডঃ প্রশান্ত কুমার ভট্টাচার্য
পৃষ্ঠা: ৪৮২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন