কলিকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় হইতে সদানন্দ চক্রবর্তী দর্শন শাস্ত্রে এম.এ পাশ করিলেন।
মধ্য কলিকাতার বাসা ছাড়িয়া আসিলেন ভবানীপুর অঞ্চলে গৌরভক্ত মিত্র পরিবারের
বাসগৃহের একাংশে। মিত্রপরিবারের একজন জ্যোত্স্নাবাবুর সহিত সদানন্দবাবুর
বন্ধুত্বের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছিল। সদানন্দবাবু যখন মধ্য কলিকাতার আবাস
ছাড়িয়া অন্যত্র বাসাবাড়ি অন্বেষণ করিতেছিলেন তখন জ্যোত্স্নাবাবু এবং তাহার
পরিবারের অন্যরা সদানন্দবাবুকে তাঁহাদের বাসগৃহে থাকিতে অনুরোধ করিলে তাঁহাদের আন্তরিক আহ্বান তিনি উপেক্ষা করিতে পারিলেন না।
সমূহ বাসস্থানের সমস্যা এইভাবেই সমাধান হইল। এইবার কর্মজীবনের পথ নির্ব্বাচনের ভাবনায় তিনি ভাবিত। কারণ বহুদিন ধরিয়া তিনি হৃদয়ে সযত্নে লালন করিয়া আসিতেছেন যে পরের বাঁধাধরা চাকুরী করিবেন না। কিন্তু কিছু একটা উপার্জনের রাস্তা বাহির করিতে হইবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একবার শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, "সংসারে সাধারনভাবে থাকিতে গেলেও একটা কিছু করিতে হয়।" যে সময় ঠাকুরমহাশয় এই উক্তি করিয়াছিলেন তখন উভয়ের মধ্যে যে কথোপকথন হয়। -
ঠাকুর: আপনি ওকালতি পড়েন।
সদানন্দ: ওকালতি আমার দ্বারা হইবে না। কারণ ওকালতি করিতে অনেক মিথ্যা বলিতে হয়।
ঠাকুর: মিথ্যা কথা না বইল্যাও ওকালতি করা যায়।
সদানন্দ: ওকালতিতে তাহাসম্ভব হয় না।
ঠাকুর: আচ্ছা ওকালতি না করিতে পারেন, পুলিশে চাকরী নেন গিয়া। তবে আপনাকে আইন আদালতের কাজ কিছু করতেই হইব।
বাস্তবিকই সদানন্দবাবুকে তাঁহার জীবনের কিছু সময় আইন আদালতের কাজে সংযুক্ত থাকিতে হইয়াছিল।
সে যাহা হউক, তখন ঠাকুরের শ্রীমুখে পুলিশের চাকুরী কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু বলিলেন, "ঠাকুর মশায় একবার আপনিই তো আমাকে বলিয়াছিলেন, এল, এ, বি, এ পাশ করিয়া কী হইবে সেই ত কোন অফিসে বড় কর্ত্তার অধীনে জো হুজুর, জো হুজুর করিবেন।"
সদানন্দবাবুর এক কথার উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেন, "সংসারে সাধারণ ভাবে থাকিতে গেলেও একটা কিছু করিতে হয়।"
তারপর ঠাকুরের কথায় তিনি একবার পুলিশের চাকুরীর চেষ্টাও করিয়াছিলেন।তাহাতে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে একটি পদের নিয়োগ পত্রও পাইয়াছিলেন। চাকুরীর চিঠি হাতে আসিলে তাহা পড়িয়া তত্ক্ষনাত ছিড়িয়া ফেলিলেন।
এইভাবেই কর্ম জীবনের প্রারম্ভে সদানন্দবাবুর টানা পোড়ান চলিতেছিল।এমন সময়ে আকস্মিক ভাবে সদানন্দের সহিত ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। অতীতে নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা কংগ্রেস দলের স্বনামধন্য নেতা শ্রীসত্যেন্দ্র চন্দ্র মিত্র মহাশয় সদানন্দকে লইয়া ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় মহাশয়ের গৃহে আসিলেন। ডাক্তার রায়ের সহিত পরিচিত হওয়া না হওয়ার কোনরূপ ইচ্ছাই সদানন্দবাবুর ছিল না। মিত্র মহাশয় স্বয়ং কী মনে করিয়া ডাঃ রায়ের বাস ভবনে তাহাকে সঙ্গে লইয়া গেলেন। কংগ্রেসের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দুইজন নেতার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া নানা কথাবার্ত্তা চলিতেছিল।অদূরে সদানন্দ চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। ডাঃ রায় তাঁহাদের কথার মাঝে মাঝে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন।এইরূপে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়া যাওয়ার পর তাঁহাদের কথোপথনের অবসান হইলে ডাঃ রায় মিত্র মহাশয়কে প্রশ্ন করিলেন, "এই ছেলে টি কে, কোন চাকুরীর ফিকিরে এসেছে নিশ্চয়ই।" তাহার উত্তরে মিত্র মহাশয় বলিলেন, "একেবারেই তা সত্য নয়। আমি যতদূর জানি এই ছেলেটির চাকুরী করার কোন ইচ্ছাই নেই। আমি নিজেই ওকে সঙ্গে করে এখানে এনেছি। ছেলেটি অতিমাত্রায় সৎ, কর্মনিষ্ঠ এবং বুদ্ধিমান। বিশেষ করে আমি যতদূর বুঝেছি এর একটি বড় গুন এই বয়সেই সে ঈশ্বর সন্ধানী। এমন একটি ছেলে কোন কাজে লাগতে পারে ভেবেই তোমার কাছে নিয়ে আসা।কলিকাতায় সে সম্পূর্ণ একাই থাকে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সমূহ বেকার।"ডাঃ রায় সব শুনিয়া সোজাসুজি সদানন্দকে বলিলেন, "পরে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করো।" তিনদিন পরে সদানন্দবাবু দ্বিতীয়বার আসিলেন ডাঃ রায়ের গৃহে। ডাঃ রায়ের সহিত সাক্ষাত হইতেই তিনি বলিলেন, "তুমি তিনদিন পরে এলে, পরের দিনিই কেন এলে না। "
গত তিন দিন ব্যাপী কলিকাতা হাইকোর্টে কিছু কাজে সন্ধানে তাহাকে ব্যস্ত থাকিতে হইয়াছে। সকাল এবং সন্ধ্যার পরে প্রাইভেট টিউশানি তো ছিলই। কিন্তু ডাঃ রায়ের কথা শুনিয়া তিনি মনে মনে ভাবিলেন, 'পরে দেখা করো' এই কথার অর্থ যে পরের দিনিই তাহাতো বুঝি নাই। কিন্তু ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন রাশভারি ডাঃ রায়কে তাহাতো বলা যায় না। তাই বলিলেন, "দেখুন কলিকাতায় আমি একা থাকি। থাকা,খাওয়া, চলা ফেরা ইত্যাদির জন্য আমাকে কয়েকটি ছাত্র পড়াতে হয় এবং কর্ম্মের সন্ধানেও থাকতে হয় তাই সময় করা যায়নি।"
সদানন্দবাবুর কথা শুনিয়া ডাঃ রায় বলিলেন, "তোমার মাসে কত টাকা হলে খরচ খরচা মিটে যায়?"
-এই তিরিশ টাকার মত হলেই প্রয়োজন ফুরায়ে যায়।
-"তুমি তাই পাবে আমার কিছু ব্যাক্তিগত কাজ কর্ম তোমাকে করতে হবে। তোমাকে রোজই একবার আসতে হবে। তবে কোন নির্দ্দিষ্ট সময় না হলেও চলবে।"
সেই হইতে সদানন্দবাবুর যাতায়াত শুরু হইল ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের গৃহে।প্রথমে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন।কারণ ডাঃ রায় বলিয়াছেন তাঁহার কিছু ব্যক্তিগত কাজ তাহাকে করিতে হইবে। কি এমন ব্যক্তিগত কাজ যাহা তাহাকে করিতে হইবে? কিন্তু পরে তাহার সেই শঙ্কা কাটিয়া যায়। ডাঃ রায় গোপনে দুঃস্থ ব্যাক্তিদের অর্থ সাহায্য করিতেন। ঐ সকল দান-ধ্যানের কথা ওপরে জানুক ইহা তাঁহার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নহে। দুঃস্থ বলিতে যেমন যাঁহারা সমাজের নামী, জ্ঞানীগুনিজন অথচ আর্থিক অনটনে দুঃসহ অবস্থায় আছেন। অপরের নিকট হাত পাতিয়া কিছু লইতেও তাঁহাদের সম্ভ্রমে বাধে। এমন অনেক পরিবারকে ডাঃ রায় গোপনে এমনভাবে সাহায্য করিতেন যাহাতে তাঁহাদের সম্মানহানি না ঘটে। তাহা ছাড়া গরিব দুঃখী এবং কোন কন্যাদায়গ্রস্থ ব্যাক্তি, মন্দির, মসজিদ নির্মান কল্পে অর্থ সাহায্য ডাঃ রায় নিয়ত গোপনেই করিতে চেষ্টা করিতেন। সাধারণত এই সকল কাজ যাহার মাধ্যমে করিতে হয় তাহাকে একান্ত ভাবেই সৎ এবং বুদ্ধিমান হইতে হয়। সদানন্দবাবু ক্রমে ক্রমে ডাঃ রায়ের সেই বিশ্বাস অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
পরে এমন হইয়াছিল যে সদানন্দ ডাঃ রায়ের একান্ত আপন জনের মত তাঁহার পরিবারের একজন হইয়া গিয়াছিলেন।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের কথা বলিতে যাইয়া কোন কথায় আসিয়া পরিলাম এই ভাবিয়া প্রিয় ভক্ত পাঠক বৃন্দ আপনারা হয়ত অধৈর্য্য হইয়া উঠিয়াছেন। শ্রীশ্রী রামঠাকুরের সঙ্গে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের যে একটি যোগাযোগ সুত্র ছিল, এই সত্যটি ডাঃ রায়ের জীবন কথায় ছিল সম্পূর্ণ উহ্য। এই বিষয়টি সদানন্দবাবুর অনুমান সাপেক্ষে হইলেও তাঁহার দৃঢ় ধারণা ছিল এই সম্বন্ধে। কীরূপে তাঁহার এইরূপ দৃঢ় ধারণা হয় সেই কথাটি বলার চেষ্টা করা হইতেছে -
সদানন্দবাবুর কাছে জানিলাম ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের অমৃতি-প্রীতি ছিল। রাত্রিতে খাওয়ার পরে শয়নে যাইবার পূর্বে একটি অমৃতি খাইতেন তিনি। এবং তত্সঙ্গে একান্ত অন্তরঙ্গ জনেদের লইয়া কিছুক্ষণের জন্য হালকা আলোচনার আসর বসাইতেন। সেই গল্পগুজবের আসরে যাহারা উপস্থিত থাকিতেন প্রত্যেককে অমৃতি পরিবেশন করা হইত। ডাঃ রায় একখানা অমৃতিই খাইতেন। কিন্তু তাঁহার নির্দেশে উত্তর কলিকাতার একটি হালুইকরের দোকান হইতে নিয়মিতভাবে অনেকটাই অমৃতি প্রতিদিন অসিত। ডাঃ রায় ওই আসরে সদানন্দবাবুকে উপস্থিত থাকিতে বলিতেন। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে না হইলেও মাঝে মধ্যে সদানন্দবাবু উপস্থিত থাকার চেষ্টা করিতেন। ডাক্তার বিধান চন্দ্ররায় ব্রাহ্মধর্মালম্বী ছিলেন। এই ধর্ম্মাচরণ তাঁহার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া। পূর্ব কথায় আছে তাঁহার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হইলে তাঁহার পিতৃদেব অর্থাৎ ডাঃ রায়ের ঠাকুরদা কত্তৃক তিনি গৃহ হইতে বিতাড়িত হন।
একদিন রাত্রিবেলায় অমৃতি খাওয়ার আসরে সদানন্দবাবু উপস্থিত আছেন। মজলিসের আলোচনার বিষয় ছিল আধ্যাত্মিকতা। ডাঃ রায় সদানন্দের দিকে চাহিয়া একসময় বলিতে লাগিলেন, "ব্রাহ্মমতটি তথা কথিত হিন্দু ধর্ম্মাচরণ কারীদের কুসংস্কার আর গোঁড়ামীর থেকে অনেকটাই মুক্ত, সদানন্দ তুমি কি বল।
এইখানে বলা প্রয়োজন ডাঃ রায়কে সদানন্দবাবু 'স্যার' বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ডাক্তার রায়ের কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু এবং ডাঃ রায়ের মধ্যে যেরূপ কথোপকথন হইয়া থাকে। -
সদানন্দ: দেখুন স্যার, নিরাকারে বিশ্বাসী ব্রাহ্মমতটি নিঃসন্দেহে ভালো।আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের উদ্দ্যেশ্য যদি ভগবান প্রাপ্তি হয় তাহলে আধ্যাত্মিক সাধনার অন্তিমে সকলকেই নিরাকারে যেতে হবে। কিন্তু "অহং ব্রহ্মহস্মি" এই বাক্যে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার আপত্তি আছে অর্থাৎ এ কথায় মনে একরকম সংশয় জাগে।
ডাঃ রায়: তোমার সংশয়ের কারণ?
সদানন্দ: কারণ, প্রাথমিক ভাবে আমিই ব্রহ্ম, ইহা বলা বা ভাবার মধ্যে অহংগ্ভাব-আসে না কি?
ডাঃ রায়: হ্যা ঠিক, আসে বৈ কী।
সদানন্দ: অহং আবির্ভাবে নিজের কতৃত্ব প্রকাশ হয়ে পড়ে না কি?
ডাঃ রায়: হ্যা, তা পড়ে বৈকি।
সদানন্দ: তাহলে অহংকার ত্যাগ কোথায় হলো। কারণ শাস্ত্রে আছে- শাস্ত্র না মানলে মহাজন বাক্যে আছে অহংকার অবশ্যই বর্জনীয়, নচেত সাধন পথে ভগবান লাভ করা সুদূরপরাহত। অথচ উদ্দ্যেশ্য যদি ভগবান প্রাপ্তি, তবে প্রারম্ভে আমিই ব্রহ্ম এই উক্তি তো যুক্তি যুক্ত ঠেকছে না।
ডাঃ রায়: হ্যা, যুক্তি আছে বুঝলাম।
এই কথা বলিয়াই ডাঃ কহিলেন, "দেখ, আমারও গুরু আছেন। তবে তাঁর নাম জানতে চেয়ো না, আমি বলব না।"
ডাঃ রায়ের কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু ভাবিতে লাগিলেন - এতক্ষণ আমি যাহা বলিলাম সব কিছুতেই ডাঃ রায়ের সায় পাওয়া গেল। অর্থাৎ সব কথাতেই হু, ঠিক, এই শব্দগুলি উচ্চারিত হইল। ডাঃ রায়ের মত রাশভারি ব্যাক্তিত্ব, যিনি অপরের কোন কথাতেই সহজে সায় দিতে চাহেন না। সেই তিনি কিনা আমার সব কথায় সম্মতি সূচক উক্তি করিয়া গেলেন। আমি তো যাহা কিছু বলিলাম সবই শ্রীশ্রী রামঠাকুরের পথ, মতের সমন্বয়েই বলার চেষ্টা করিয়া গিয়াছি। তাহা শুনিয়া তিনি এখন বলিতেছেন যে তাঁহারও গুরু আছেন। কিন্তু গুরুর নাম বলিবেন না বলিয়া দৃঢ়তা প্রকাশ করিলেন। ইত্যাদি ভাবনায় ভাবিত হইয়া কয়েক মুহুর্ত্ত পরে সদানন্দবাবু ডাক্তার রায়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, -"আচ্ছা স্যার, আপনার গুরু নাম না হয় নাই বললেন, আপনার গুরু নিশ্চয়ই আপনাকে কিছু উপদেশ দিয়াছেন ।এমন দুই, একটি উপদেশ বাণী বলতে আপনার আপত্তি আছে কী স্যার, তা শুনে আমাদেরও কাজে লাগতে পারে বৈকি।
ডাঃ রায়: আপত্তির কারণ দেখিনা। তা বলা যেতে পারে।
বলিয়া একটু সময় নিয়া বলিতে লাগিলেন,
-নিরহঙ্কারী হওয়া।
-কতৃত্ব বুদ্ধি ত্যাগ করা।
-ধৈর্য্য ধরা।
এর পরেই সদানন্দ ডাঃ রায়ের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, 'পরের শব্দটা কি স্যার সহ্য করা?’
কপট দৃষ্টিতে সদানন্দের দিকে চাহিয়া ডাঃ রায় কহিলেন, "ডেপো ছেলে কোথাকার।" বলিয়া চুপ করিয়া গেলেন। আর কিছুতেই বলিলেন না। এই খানেই সেদিনের অমৃতি মজলিশের ইতি ঘটিল।
উপরিউক্ত কাহিনী ব্যক্ত করিয়া শ্রদ্ধেয় সদানন্দদা কহিলেন, "এতে আমার অনুমান ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় সেদিন শ্রীশ্রী রামঠাকুরের উপদেশ বাণীর কথাই বলিয়াছিলেন। অবশ্য ইহা সম্পূর্ণ আমার অনুমান সাপেক্ষ।"
ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা: ২৬৯
সমূহ বাসস্থানের সমস্যা এইভাবেই সমাধান হইল। এইবার কর্মজীবনের পথ নির্ব্বাচনের ভাবনায় তিনি ভাবিত। কারণ বহুদিন ধরিয়া তিনি হৃদয়ে সযত্নে লালন করিয়া আসিতেছেন যে পরের বাঁধাধরা চাকুরী করিবেন না। কিন্তু কিছু একটা উপার্জনের রাস্তা বাহির করিতে হইবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একবার শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, "সংসারে সাধারনভাবে থাকিতে গেলেও একটা কিছু করিতে হয়।" যে সময় ঠাকুরমহাশয় এই উক্তি করিয়াছিলেন তখন উভয়ের মধ্যে যে কথোপকথন হয়। -
ঠাকুর: আপনি ওকালতি পড়েন।
সদানন্দ: ওকালতি আমার দ্বারা হইবে না। কারণ ওকালতি করিতে অনেক মিথ্যা বলিতে হয়।
ঠাকুর: মিথ্যা কথা না বইল্যাও ওকালতি করা যায়।
সদানন্দ: ওকালতিতে তাহাসম্ভব হয় না।
ঠাকুর: আচ্ছা ওকালতি না করিতে পারেন, পুলিশে চাকরী নেন গিয়া। তবে আপনাকে আইন আদালতের কাজ কিছু করতেই হইব।
বাস্তবিকই সদানন্দবাবুকে তাঁহার জীবনের কিছু সময় আইন আদালতের কাজে সংযুক্ত থাকিতে হইয়াছিল।
সে যাহা হউক, তখন ঠাকুরের শ্রীমুখে পুলিশের চাকুরী কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু বলিলেন, "ঠাকুর মশায় একবার আপনিই তো আমাকে বলিয়াছিলেন, এল, এ, বি, এ পাশ করিয়া কী হইবে সেই ত কোন অফিসে বড় কর্ত্তার অধীনে জো হুজুর, জো হুজুর করিবেন।"
সদানন্দবাবুর এক কথার উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেন, "সংসারে সাধারণ ভাবে থাকিতে গেলেও একটা কিছু করিতে হয়।"
তারপর ঠাকুরের কথায় তিনি একবার পুলিশের চাকুরীর চেষ্টাও করিয়াছিলেন।তাহাতে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে একটি পদের নিয়োগ পত্রও পাইয়াছিলেন। চাকুরীর চিঠি হাতে আসিলে তাহা পড়িয়া তত্ক্ষনাত ছিড়িয়া ফেলিলেন।
এইভাবেই কর্ম জীবনের প্রারম্ভে সদানন্দবাবুর টানা পোড়ান চলিতেছিল।এমন সময়ে আকস্মিক ভাবে সদানন্দের সহিত ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। অতীতে নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা কংগ্রেস দলের স্বনামধন্য নেতা শ্রীসত্যেন্দ্র চন্দ্র মিত্র মহাশয় সদানন্দকে লইয়া ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় মহাশয়ের গৃহে আসিলেন। ডাক্তার রায়ের সহিত পরিচিত হওয়া না হওয়ার কোনরূপ ইচ্ছাই সদানন্দবাবুর ছিল না। মিত্র মহাশয় স্বয়ং কী মনে করিয়া ডাঃ রায়ের বাস ভবনে তাহাকে সঙ্গে লইয়া গেলেন। কংগ্রেসের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দুইজন নেতার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া নানা কথাবার্ত্তা চলিতেছিল।অদূরে সদানন্দ চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। ডাঃ রায় তাঁহাদের কথার মাঝে মাঝে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন।এইরূপে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়া যাওয়ার পর তাঁহাদের কথোপথনের অবসান হইলে ডাঃ রায় মিত্র মহাশয়কে প্রশ্ন করিলেন, "এই ছেলে টি কে, কোন চাকুরীর ফিকিরে এসেছে নিশ্চয়ই।" তাহার উত্তরে মিত্র মহাশয় বলিলেন, "একেবারেই তা সত্য নয়। আমি যতদূর জানি এই ছেলেটির চাকুরী করার কোন ইচ্ছাই নেই। আমি নিজেই ওকে সঙ্গে করে এখানে এনেছি। ছেলেটি অতিমাত্রায় সৎ, কর্মনিষ্ঠ এবং বুদ্ধিমান। বিশেষ করে আমি যতদূর বুঝেছি এর একটি বড় গুন এই বয়সেই সে ঈশ্বর সন্ধানী। এমন একটি ছেলে কোন কাজে লাগতে পারে ভেবেই তোমার কাছে নিয়ে আসা।কলিকাতায় সে সম্পূর্ণ একাই থাকে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সমূহ বেকার।"ডাঃ রায় সব শুনিয়া সোজাসুজি সদানন্দকে বলিলেন, "পরে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করো।" তিনদিন পরে সদানন্দবাবু দ্বিতীয়বার আসিলেন ডাঃ রায়ের গৃহে। ডাঃ রায়ের সহিত সাক্ষাত হইতেই তিনি বলিলেন, "তুমি তিনদিন পরে এলে, পরের দিনিই কেন এলে না। "
গত তিন দিন ব্যাপী কলিকাতা হাইকোর্টে কিছু কাজে সন্ধানে তাহাকে ব্যস্ত থাকিতে হইয়াছে। সকাল এবং সন্ধ্যার পরে প্রাইভেট টিউশানি তো ছিলই। কিন্তু ডাঃ রায়ের কথা শুনিয়া তিনি মনে মনে ভাবিলেন, 'পরে দেখা করো' এই কথার অর্থ যে পরের দিনিই তাহাতো বুঝি নাই। কিন্তু ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন রাশভারি ডাঃ রায়কে তাহাতো বলা যায় না। তাই বলিলেন, "দেখুন কলিকাতায় আমি একা থাকি। থাকা,খাওয়া, চলা ফেরা ইত্যাদির জন্য আমাকে কয়েকটি ছাত্র পড়াতে হয় এবং কর্ম্মের সন্ধানেও থাকতে হয় তাই সময় করা যায়নি।"
সদানন্দবাবুর কথা শুনিয়া ডাঃ রায় বলিলেন, "তোমার মাসে কত টাকা হলে খরচ খরচা মিটে যায়?"
-এই তিরিশ টাকার মত হলেই প্রয়োজন ফুরায়ে যায়।
-"তুমি তাই পাবে আমার কিছু ব্যাক্তিগত কাজ কর্ম তোমাকে করতে হবে। তোমাকে রোজই একবার আসতে হবে। তবে কোন নির্দ্দিষ্ট সময় না হলেও চলবে।"
সেই হইতে সদানন্দবাবুর যাতায়াত শুরু হইল ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের গৃহে।প্রথমে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন।কারণ ডাঃ রায় বলিয়াছেন তাঁহার কিছু ব্যক্তিগত কাজ তাহাকে করিতে হইবে। কি এমন ব্যক্তিগত কাজ যাহা তাহাকে করিতে হইবে? কিন্তু পরে তাহার সেই শঙ্কা কাটিয়া যায়। ডাঃ রায় গোপনে দুঃস্থ ব্যাক্তিদের অর্থ সাহায্য করিতেন। ঐ সকল দান-ধ্যানের কথা ওপরে জানুক ইহা তাঁহার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নহে। দুঃস্থ বলিতে যেমন যাঁহারা সমাজের নামী, জ্ঞানীগুনিজন অথচ আর্থিক অনটনে দুঃসহ অবস্থায় আছেন। অপরের নিকট হাত পাতিয়া কিছু লইতেও তাঁহাদের সম্ভ্রমে বাধে। এমন অনেক পরিবারকে ডাঃ রায় গোপনে এমনভাবে সাহায্য করিতেন যাহাতে তাঁহাদের সম্মানহানি না ঘটে। তাহা ছাড়া গরিব দুঃখী এবং কোন কন্যাদায়গ্রস্থ ব্যাক্তি, মন্দির, মসজিদ নির্মান কল্পে অর্থ সাহায্য ডাঃ রায় নিয়ত গোপনেই করিতে চেষ্টা করিতেন। সাধারণত এই সকল কাজ যাহার মাধ্যমে করিতে হয় তাহাকে একান্ত ভাবেই সৎ এবং বুদ্ধিমান হইতে হয়। সদানন্দবাবু ক্রমে ক্রমে ডাঃ রায়ের সেই বিশ্বাস অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
পরে এমন হইয়াছিল যে সদানন্দ ডাঃ রায়ের একান্ত আপন জনের মত তাঁহার পরিবারের একজন হইয়া গিয়াছিলেন।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের কথা বলিতে যাইয়া কোন কথায় আসিয়া পরিলাম এই ভাবিয়া প্রিয় ভক্ত পাঠক বৃন্দ আপনারা হয়ত অধৈর্য্য হইয়া উঠিয়াছেন। শ্রীশ্রী রামঠাকুরের সঙ্গে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের যে একটি যোগাযোগ সুত্র ছিল, এই সত্যটি ডাঃ রায়ের জীবন কথায় ছিল সম্পূর্ণ উহ্য। এই বিষয়টি সদানন্দবাবুর অনুমান সাপেক্ষে হইলেও তাঁহার দৃঢ় ধারণা ছিল এই সম্বন্ধে। কীরূপে তাঁহার এইরূপ দৃঢ় ধারণা হয় সেই কথাটি বলার চেষ্টা করা হইতেছে -
সদানন্দবাবুর কাছে জানিলাম ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের অমৃতি-প্রীতি ছিল। রাত্রিতে খাওয়ার পরে শয়নে যাইবার পূর্বে একটি অমৃতি খাইতেন তিনি। এবং তত্সঙ্গে একান্ত অন্তরঙ্গ জনেদের লইয়া কিছুক্ষণের জন্য হালকা আলোচনার আসর বসাইতেন। সেই গল্পগুজবের আসরে যাহারা উপস্থিত থাকিতেন প্রত্যেককে অমৃতি পরিবেশন করা হইত। ডাঃ রায় একখানা অমৃতিই খাইতেন। কিন্তু তাঁহার নির্দেশে উত্তর কলিকাতার একটি হালুইকরের দোকান হইতে নিয়মিতভাবে অনেকটাই অমৃতি প্রতিদিন অসিত। ডাঃ রায় ওই আসরে সদানন্দবাবুকে উপস্থিত থাকিতে বলিতেন। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে না হইলেও মাঝে মধ্যে সদানন্দবাবু উপস্থিত থাকার চেষ্টা করিতেন। ডাক্তার বিধান চন্দ্ররায় ব্রাহ্মধর্মালম্বী ছিলেন। এই ধর্ম্মাচরণ তাঁহার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া। পূর্ব কথায় আছে তাঁহার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হইলে তাঁহার পিতৃদেব অর্থাৎ ডাঃ রায়ের ঠাকুরদা কত্তৃক তিনি গৃহ হইতে বিতাড়িত হন।
একদিন রাত্রিবেলায় অমৃতি খাওয়ার আসরে সদানন্দবাবু উপস্থিত আছেন। মজলিসের আলোচনার বিষয় ছিল আধ্যাত্মিকতা। ডাঃ রায় সদানন্দের দিকে চাহিয়া একসময় বলিতে লাগিলেন, "ব্রাহ্মমতটি তথা কথিত হিন্দু ধর্ম্মাচরণ কারীদের কুসংস্কার আর গোঁড়ামীর থেকে অনেকটাই মুক্ত, সদানন্দ তুমি কি বল।
এইখানে বলা প্রয়োজন ডাঃ রায়কে সদানন্দবাবু 'স্যার' বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ডাক্তার রায়ের কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু এবং ডাঃ রায়ের মধ্যে যেরূপ কথোপকথন হইয়া থাকে। -
সদানন্দ: দেখুন স্যার, নিরাকারে বিশ্বাসী ব্রাহ্মমতটি নিঃসন্দেহে ভালো।আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের উদ্দ্যেশ্য যদি ভগবান প্রাপ্তি হয় তাহলে আধ্যাত্মিক সাধনার অন্তিমে সকলকেই নিরাকারে যেতে হবে। কিন্তু "অহং ব্রহ্মহস্মি" এই বাক্যে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার আপত্তি আছে অর্থাৎ এ কথায় মনে একরকম সংশয় জাগে।
ডাঃ রায়: তোমার সংশয়ের কারণ?
সদানন্দ: কারণ, প্রাথমিক ভাবে আমিই ব্রহ্ম, ইহা বলা বা ভাবার মধ্যে অহংগ্ভাব-আসে না কি?
ডাঃ রায়: হ্যা ঠিক, আসে বৈ কী।
সদানন্দ: অহং আবির্ভাবে নিজের কতৃত্ব প্রকাশ হয়ে পড়ে না কি?
ডাঃ রায়: হ্যা, তা পড়ে বৈকি।
সদানন্দ: তাহলে অহংকার ত্যাগ কোথায় হলো। কারণ শাস্ত্রে আছে- শাস্ত্র না মানলে মহাজন বাক্যে আছে অহংকার অবশ্যই বর্জনীয়, নচেত সাধন পথে ভগবান লাভ করা সুদূরপরাহত। অথচ উদ্দ্যেশ্য যদি ভগবান প্রাপ্তি, তবে প্রারম্ভে আমিই ব্রহ্ম এই উক্তি তো যুক্তি যুক্ত ঠেকছে না।
ডাঃ রায়: হ্যা, যুক্তি আছে বুঝলাম।
এই কথা বলিয়াই ডাঃ কহিলেন, "দেখ, আমারও গুরু আছেন। তবে তাঁর নাম জানতে চেয়ো না, আমি বলব না।"
ডাঃ রায়ের কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু ভাবিতে লাগিলেন - এতক্ষণ আমি যাহা বলিলাম সব কিছুতেই ডাঃ রায়ের সায় পাওয়া গেল। অর্থাৎ সব কথাতেই হু, ঠিক, এই শব্দগুলি উচ্চারিত হইল। ডাঃ রায়ের মত রাশভারি ব্যাক্তিত্ব, যিনি অপরের কোন কথাতেই সহজে সায় দিতে চাহেন না। সেই তিনি কিনা আমার সব কথায় সম্মতি সূচক উক্তি করিয়া গেলেন। আমি তো যাহা কিছু বলিলাম সবই শ্রীশ্রী রামঠাকুরের পথ, মতের সমন্বয়েই বলার চেষ্টা করিয়া গিয়াছি। তাহা শুনিয়া তিনি এখন বলিতেছেন যে তাঁহারও গুরু আছেন। কিন্তু গুরুর নাম বলিবেন না বলিয়া দৃঢ়তা প্রকাশ করিলেন। ইত্যাদি ভাবনায় ভাবিত হইয়া কয়েক মুহুর্ত্ত পরে সদানন্দবাবু ডাক্তার রায়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, -"আচ্ছা স্যার, আপনার গুরু নাম না হয় নাই বললেন, আপনার গুরু নিশ্চয়ই আপনাকে কিছু উপদেশ দিয়াছেন ।এমন দুই, একটি উপদেশ বাণী বলতে আপনার আপত্তি আছে কী স্যার, তা শুনে আমাদেরও কাজে লাগতে পারে বৈকি।
ডাঃ রায়: আপত্তির কারণ দেখিনা। তা বলা যেতে পারে।
বলিয়া একটু সময় নিয়া বলিতে লাগিলেন,
-নিরহঙ্কারী হওয়া।
-কতৃত্ব বুদ্ধি ত্যাগ করা।
-ধৈর্য্য ধরা।
এর পরেই সদানন্দ ডাঃ রায়ের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, 'পরের শব্দটা কি স্যার সহ্য করা?’
কপট দৃষ্টিতে সদানন্দের দিকে চাহিয়া ডাঃ রায় কহিলেন, "ডেপো ছেলে কোথাকার।" বলিয়া চুপ করিয়া গেলেন। আর কিছুতেই বলিলেন না। এই খানেই সেদিনের অমৃতি মজলিশের ইতি ঘটিল।
উপরিউক্ত কাহিনী ব্যক্ত করিয়া শ্রদ্ধেয় সদানন্দদা কহিলেন, "এতে আমার অনুমান ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় সেদিন শ্রীশ্রী রামঠাকুরের উপদেশ বাণীর কথাই বলিয়াছিলেন। অবশ্য ইহা সম্পূর্ণ আমার অনুমান সাপেক্ষ।"
ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা: ২৬৯
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন