পূর্ণ ব্রহ্ম সনাতন, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় কারণ, সত্যনারায়ণ, আমিই সেই রামঠাকুর।
তিরিশ দশকের প্রারম্ভে ঢাকা হইতে সদানন্দকে সঙ্গে লইয়া ঠাকুর মহাশয় আসিলেন পূর্ববঙ্গের ভৈরব ষ্টেশনের রেল আবাসনে। সেখানে শ্রীযুক্ত ললিত রায় মহাশয়ের আবাসে শ্রীশ্রী রামঠাকুর শুভবিজয় করিতেছেন। প্রতিদিন বিশেষ করিয়া ছুটির দিন সকাল সন্ধ্যায় অপেক্ষাকৃত অধিক ভক্তকূল শ্রীশ্রী ঠাকুর সন্নিধানে আসিয়া তাঁহার অমৃতময় কথা শ্রবণ করিয়া আনন্দ লাভ করিতেছেন। রেল আবাসন এবং আশপাশের আশ্রিত অনাশ্রিত নির্ব্বিশেষে ধর্ম্মপিপাসু ভক্ত সমাজে শ্রীশ্রী ঠাকুরের শুভাগমনে সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। স্ত্রীপুরুষ সকলে শ্রীশ্রী ঠাকুরকে দর্শন ও প্রনাম করিতে ব্যস্ত। কেহ কেহ নাম চাহিয়া নাম পাইতেছেন।
ললিত রায়ের গৃহের চারিদিকে যেন আনন্দের হাট বসিয়াছে। এইভাবে একদিন সকাল বেলায় জাতিতে ব্রাহ্মন, স্থানীয় একজন তথাকথিত পন্ডিত শ্রেনীর ব্যক্তি ললিত রায় মহাশয়ের গৃহবাসের সম্মুখে আসিয়া পান্ডিত্যের গৌরবে গর্বিত হইয়া পন্ডিত উচ্চ কন্ঠে বলিতে লাগিলেন, "কৈ গো তোমাদের রামঠাকুর, তিনি নাকি ভগবান, তাঁরে একবার দেইখা যাই।"
অহঙ্কারী পন্ডিতের শ্লেষপূর্ণ বাক্য শুনিয়া সেখানে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত। গৃহ মধ্যে ভক্ত পরিবৃত হইয়া ঠাকুর মহাশয় একখানা তক্তপোষের উপর তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বসিয়া আছেন। উদ্ধত পন্ডিতের কথা শ্রবণ করিয়া শ্রীশ্রী ঠাকুর শান্তভাবে বাহিরে আসিয়া সেই পন্ডিতের সম্মুখে দন্ডায়মান পূর্বক তাহার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া উদাত্ত কন্ঠে বলিতে লাগিলেন, -
"পুর্ণব্রহ্ম সনাতন, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় কারণ, সত্যনারায়ণ, আমিই সেই রামঠাকুর।"
পান্ডিত্যের অহঙ্কারে অহঙ্কারী পন্ডিত প্রবর কথাগুলি শুনিতে শুনিতে শ্রীশ্রী ঠাকুরের মধ্যে কী দেখিতে পাইলেন তাহা তিনিই জানেন। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ কিছুই অনুমান করিতে পারিলেন না। তাঁহারা শুধু লক্ষ্য করিলেন সেই আত্মাভিমানী গর্বিত পন্ডিত মুহুর্তের মধ্যে থর থর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভূপাতিত হইলেন। তখন উপস্থিত সকলের মধ্যে চঞ্চলতা শুরু হইয়া গেল। কেহ কেহ তাঁহার শুশ্রুষায় ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। চোখে মুখে শিরে জলক্ষেপনপূর্বক তাঁহাকে সকলে ধরাধরি করিয়া যে ঘরে ঠাকুর মহাশয় আছেন সেখানে ঘরের মেঝেতে শোয়াইয়া দিলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর পুনরায় তাঁহার পূর্ব নির্দ্দিষ্ট আসনে বসিয়া নির্লিপ্তের ন্যায় সব কিছু অবলোকন করিয়া যাইতেছেন। কিছুক্ষণ পরে পন্ডিতের সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল। জ্ঞান ফিরিবার পরে দাম্ভিক পন্ডিত শ্রীশ্রী ঠাকুরের সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিলেন। তারপর হাতজোড় করিয়া কম্পিত কন্ঠে ঠাকুরের শ্রীমুখপানে চাহিয়া সাশ্রুনয়নে গীতার একাদশ অধ্যায় আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। সদানন্দদা বলিলেন যে গীতার একাদশ অধ্যায় বিশ্বরূপ দর্শন সম্পূর্ণ আবৃত্তি করিতে মুহুর্মুহু কাঁপিয়া উঠিতেছিলেন। তখনও পর্য্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে পারেন নাই। যতক্ষণ তিনি গীতার শ্লোকগুলি পাঠ করিতেছিলেন, ঠাকুরমহাশয় তাঁহার আসনে স্থির ভাবে বসিয়াছিলেন। আবৃত্তি শেষে ব্রাহ্মণের অবস্থা দেখিয়া ঠাকুর বলিলেন, "ওনারে একটু গরম দুধ খাওয়াইয়া বাড়ি পৌঁছাইয়া দেন। একটুকু বিশ্রাম করলেই ঠিক হইয়া যাইব।"
উপরি উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সদানন্দ চক্রবর্তী মহাশয় ঐ কাহিনী বলিবার পরে তিনি শ্রীশ্রী ঠাকুরের মহিমা মন্ডিত আরও একটি বিষয়ে আলোকপাত করিয়াছিলেন। এই ললিত রায়দের বংশের একটি বালককে দত্তক নিয়েছিলেন জনৈক চট্টোপাধ্যায় মহাশয়।
তাঁহার কোন সন্তানাদি ছিল না। বহুদিন আগের কথা সদানন্দবাবু ওই চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের নাম স্মরণ করিতে পারিলেন না। চ্যাটার্জি মহাশয় ছিলেন গুরুকৃপাধন্য এক ব্যক্তি।
আর্থিক অবস্থা তাঁহার ভালই ছিল। কিন্তু প্রারব্ধ দন্দভোগ তাঁহার এতই প্রবল ছিল যে ঠাকুর মহাশয় স্বয়ং চ্যাটার্জিবাবুর জন্য চিন্তাযুক্ত থাকিতেন। চিন্তিত ঠাকুর মহাশয়কে তাঁহার গুরুদেব চ্যাটার্জিবাবুর নাম উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন, "রাম, অমুকের চিন্তা তোমাকে করিতে হইবে না, তাহার ভার আমি নিলাম।"
এইরূপ বলিয়া গুরুদেব একটি রুদ্রাক্ষের মালা ঠাকুরের হাতে দিয়া বলিয়াছিলেন, "তাহাকে এই রুদ্রাক্ষের মালায় নাম জপিতে বলিবে।" শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁহার গুরুদেবের কথানুযায়ী তাহাই করিয়াছিলেন। কিছুদিন পরে পরম গুরু অর্থাৎ ঠাকুরের গুরুদেব পুনরায় ঠাকুরকে বলিয়াছিলেন, "তাহার আর রুদ্রাক্ষের মালা জপের প্রয়োজন নাই।"
অনেক পরে শ্রী প্রমথ চক্রবর্তী, শ্রীযুক্ত শ্রীমন্ত কুমার বনিক, শ্রীসদানন্দ চক্রবর্তী প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ যখন যাদবপুর কৈবল্যধামের ট্রাষ্টি বোর্ড সদস্য, তখন তাঁহারা সকলে মিলিয়া শ্রীশ্রী ঠাকুরের গুরুদেব প্রদত্ত রুদ্রাক্ষের মালা খানা সংগ্রহ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল পরমগুরুদেবের নিদর্শন স্বরূপ বহুমূল্যবান উক্ত রুদ্রাক্ষের মালখানা যাদবপুর আশ্রমের সংগ্রহ শালায় রাখিবেন।
কিন্তু তাঁহাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হইল। প্রকারান্তরে তাঁহারা জানিতে পারিয়াছিলেন যে জনৈক অমিয় রায়, যিনি দাদাজী নাম নিজেকে প্রকাশ করিতেন, তিনি মালখানা পূর্বাহ্নেই হস্তগত করিয়া ফেলেন। তাঁহাকে অনেক অনুনয় বিনয় করিয়াও ট্রাষ্টিবোর্ডের সদস্যগণ, পরমগুরুর পবিত্রস্পর্শ প্রাপ্ত রুদ্রাক্ষের মালখানা পাইতে সমর্থ হন নাই।
ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা: ৩১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন