মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫



এই ঘটনাটি ঘটিয়াছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম চিরতরে বাকরুদ্ধ হইয়া যাওয়ার অল্প কিছুদিন পূর্বে। সময় কালে দশটা কী সাড়ে দশটা হইবে কাজী সাহেব আর্লস্ট্রিটে কুঞ্জ বাবুর গৃহের এক তলার ঘরে প্রবেশ করিলেন। তখন কুঞ্জ মজুমদার মহাশয়ের বাড়ীর এক তলায় সপরিবারে বাস করিতেন সদানন্দ চক্রবর্তী মহাশয়। কবিকে দেখিয়া সদানন্দবাবু করজোড়ে আহ্বান করিয়া তাঁহার বৈঠকখানায় নিয়া বসাইলেন। কবির হাতে একটি থলে দেখিয়া সদানন্দদা অনুমান করিলেন হয়ত বাজার করিতে বাহির হইয়া, তিনি এইখানে চলিয়া আসিয়াছেন। খেয়ালি কবির ভাবসাব তাঁহার ভালই জানা ছিল। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের গৃহে যাতায়াতের সময় সদানন্দবাবুর সহিত কবিবরের আলাপ পরিচয় ঘটে। শুধু তাহাই নহে সেই সময় তাঁহাকে কয়েকবার কাজী সাহেবের বাসা বাড়ীতেও যাইতে হইয়াছিল। কবিকে বসিতে দিয়া সদানন্দবাবু বলিলেন, 'কাজীদা কী মনে করে আমার মত দীন হীনের ঘরে আগমন।'
-'রাজা যদি হীন, প্রজা হয় দীনের দীন। তুমি না রামঠাকুরের ভক্ত শিষ্য, দীন হতে যাবে কেন। তুমি তো দীন দুনিয়ার রাজার প্রজা। দাওনা একবারটি দর্শন করিয়ে। শুনলাম মজুমদার মশায়ের ঘরে রামঠাকুর মশায় সশরীরে আছেন।'
কবির কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু বিনয়ের সহিত কহিলেন, 'কাজীদা আজই আপনি আসার ঘন্টা খানেক আগে প্রধান মন্ত্রী হক সাহেব (তখন অখন্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধান মন্ত্রী বলা হইত) এসে ঠাকুরের দর্শন কামনা করেছিলেন। ঠাকুর মশায় তাঁকে দর্শন দেন নি এই বলে-"রাজা উজিরদের এই দরিদ্র ব্রাহ্মণের কাছে কোন দরকার আছে বইল্যা তো আমার জানা নাই।" লোক মারফৎ কথাটি শুনে হক সাহেব চলে যান।
কথাগুলি শুনিয়া নিরাশ হইলেন কবিবর। সদানন্দবাবু কাজীদার প্রিয় আহার্য্য চা এবং পানের ব্যবস্থা করিলেন। চা পান তখনও শেষ হয় নাই এমন সময়ে উপর হইতে একজন আসিয়া বলিলেন, 'এখানে কে একজন মুসলমান কবি এসেছেন তাঁকে ঠাকুর যেতে বল্লেন।'
কাজীদা মুহুর্ত্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া সদানন্দবাবুর দিকে একবার ছল ছল নেত্রে চাহিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন। সদানন্দদাও তাঁহার পিছনে পিছনে গেলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরকে দর্শন ও প্রনাম করিয়া অঞ্জলিবদ্ধ দুই হাত পাতিয়া ঠাকুরের শ্রীমুখ পানে মিনতি ভরা নয়নে চাহিয়া রহিলেন। মুখে কিছুই বলিলেন না। কবির করুন দৃষ্টিপূর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া, "এ জন্মে নয় পরের জন্মে হইব।" এই বলিয়া ঠাকুর চুপ করিয়া গেলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের কথা শুনিয়া বিদ্রোহী কবি ঠাকুরকে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করিয়া হাঁটু মুড়িয়া দুই হাত জোড় করিয়া তখন একটি গান গাহিতে লাগিলেন।
এই প্রেক্ষিতে সদানন্দদা বলিলেন যে তত্খনাত রচিত গানের ভাষা এবং সুর এতই হৃদয় বিদারক ছিল যে উপস্থিত সকলের চোখের জল ঝরিতে লাগিল। আর দেখা গেল গান গাহিতে গাহিতে বিদ্রোহী কবির দুই নয়নের অশ্রুধারা। অন্যদিকে তখন শ্রীশ্রী ঠাকুর স্থির অচঞ্চল অবস্থায় যেন ধ্যান মগ্ন। সদানন্দদা আরও জানালেন যে উক্ত ঘটনার কিছুদিন পরে তাঁহারা জানিতে পারিলেন যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ হইয়া গিয়াছেন।



ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা:৩৬৬

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন