প্রকৃত ভক্ত
ছৈয়দ খাঁ সাহেব খুব বড় লোক। যেমন তাঁর পয়সা কড়ি, সোনা মানিক, দাস দাসী, কোন কিছুর অভাব ছিল না। তেমন টাকা রোজগারের চেষ্টা বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। এদিকে তিনি বাবা ঠাকুরদার জমান টাকা দু হাতে খরচ করে চলেছেন। লোকে বলে, এক সময় খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে তাঁর স্বভাব চরিত্র খুব খারাপ হয়ে যায়। খারাপ স্বভাবের জন্য খাঁ সাহেবের খরচের হাত আরও লম্বা হয়। একদিন তাঁর সমস্ত পয়সা কড়ি শেষ হয়।
'পেট চলবে কি ভাবে?' এই ভেবে, তিনি বাধ্য হয়ে চাকরি খুঁজতে শুরু করলেন। মনের ইচ্ছা, নিজে বড় লোকের ছেলে তাই মনের মত মনিব না পেলে কোথাও চাকরি করবেন না। এই ভাবনায়, তিনি অনেক চেষ্টা করেও মনের মত মনিব খুঁজে পান নি। চাকরিও জোটে না।
একদিন ছৈয়দ খাঁ সাহেব খবর পেলেন, তাঁর এক মেয়ে বন্ধুর বাড়ীতে নাচ গানের আসর বসবে, মনিব মেলে কিনা? তার খোঁজে তিনি গেলেন সেই বাড়ীতে। গিয়ে দেখেন খুব সুন্দর এক মানুষের ছবি সাজানো রয়েছে। ছবির সেই মানুষটিকে দেখেই তাঁর ভালো লেগে গেল। খাঁ সাহেব মনে মনে ভাবেন,' চাকরী যদি করতেই হয় তবে এই মানুষটির কাছেই চাকরী করব।' উপযুক্ত মনিব খুঁজে পেয়ে তিনি সেই গানের আসরে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মাঝেই বলে উঠলেন, 'এতদিনে আমি মনের মত মনিব খুঁজে পেয়েছি। ওনার কাছেই চাকরি করব।' ছবির মানুষটিকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করলেন, 'এই ভদ্রলোকের নাম কি? কোথায় থাকেন?' ইত্যাদি অনেক কথা। আসরের প্রায় সবাই খাঁ সাহেবকে চেনেন। তাঁর কথা শুনে সবাই হো হো করে হাঁসতে শুরু করে দিলেন। আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন, 'ছৈয়দ খাঁ সাহেবের মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়েছে? তা না হলে কি কেউ এমন কথা বলে?' -যে মেয়ে বন্ধুর বাড়ীতে নাচ গানের আসর বসেছিল তিনি খাঁ সাহেবের মনের ভাব বুঝতে পেরে, বললেন, 'খাঁ সাহেব! ওনার নাম লালাজী, বৃন্দাবন ধামে বাড়ী। আপনি বৃন্দাবনে যান, সেখানে গেলেই তাঁর দর্শন মিলবে।'
বান্ধবীর কথামত ছৈয়দ খাঁ সাহেব ছুটলেন বৃন্দাবনের পথে। পথে যেতে পাছে মনিবের নাম লালাজী, ভুলে যান, তাই তাঁর নাম, মনে মনে আউড়ে চলেছেন। -এক সময় খাঁ সাহেব উপস্থিত হলেন লালাজীর দরজায়। গিয়ে দেখেন আর মনে ভাবেন, 'এ তো সাধারণ মানুষের বাড়ী নয়, এক সুন্দর মন্দির।' মন্দিরের ভিতরে না গিয়ে, তিনি মন্দিরের বাইরে দরজার এক পাশে বসে রইলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, 'হ্যা আমি এনারই চাকরী করবো। তবে এখন ভিতরে যাব না। উনি খুব বড় লোক। যখন বেড়াতে বের হবেন তখনই চাকরীর কথা বলবো।' এই ভেবে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। -দিন যায়, সন্ধ্যা নামে। আকাশের লালিমা কখন যে মুছে অন্ধকার নেমে আসে, তা তাঁর খেয়াল থাকে না। তিনি শুধু মালিকের আসার প্রহর গোনেন। - গভীর রাত, বাইরে কুকুর আর শেয়ালের ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এমন সময় ঝুম, ঝুম সুরেলা এক আওয়াজ তাঁর কানে এল। মনে হলো, আওয়াজটা মন্দিরের ভেতর থেকে আসছে। তিনি দরজার এক পাশে সরে দাঁড়ালেন। খানিকক্ষণ পরে, চাঁদের আবছা আলোতে দেখতে পেলেন, খুব সুন্দর এক পুরুষ মানুষ এক মহিলাকে সাথে নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে চলেছেন। চাঁদের আলোয় মহিলার গয়না থেকে আলো ঠিকরে বার হচ্ছে। - তাঁদের বাগানের দিকে যেতে দেখে, খাঁ সাহেবও ওনাদের পিছু পিছু চলা শুরু করলেন।
বাগানে বেড়াতে বেড়াতে মহিলা বললেন, 'এত গয়নার বোঝা নিয়ে কি বেড়ান যায়? বোঝা বইতে কষ্ট হয়।' ‘তবে খুলে ফেল।' বললেন তাঁর সাথের সেই সুন্দর পুরুষ। মহিলা তখন তাঁর গায়ের গয়না একটা একটা করে খুলে মাটিতে রেখে দিলেন। খাঁ সাহেব সবই শুনেছেন, দেখেছেন। তিনি ভাবলেন, 'আমি তো এনাদের চাকর, সাথেই আছি। গয়না সামলে রাখব। সেই মনে করেই বোধ হয় এত দামি গয়না খুলে মাটিতে রেখেছেন। চাকর হিসাবে আমারই কুড়িয়ে সাবধানে রাখা কর্তব্য। ঘরে গিয়ে যখন চাইবেন তখনই দিয়ে দেব।' এই ভেবে ঐ সব গয়না কুড়িয়ে নিয়ে, আবার তাঁদের সাথে চলতে শুরু করে দিলেন।
শেষ রাতে তাঁরা যখন আবার মন্দিরে ফিরে আসছেন তখন ছৈয়দ খাঁ সাহেবের মনে হলো, 'আমি ইসলাম ধর্মের চর্চা করি। কি করে মন্দিরে গিয়ে এই সব গয়না মনিবকে বুঝিয়ে দেব? সুযোগ বুঝে যাঁর জিনিস তাঁকেই ফেরত দেবো।' এই ভেবে তিনি সমস্ত গয়না নিয়ে, আবার আগের মত দরজার পাশে বসে রইলেন।
এদিকে পরের দিন ভোরে লালাজীর সেবক লালাজীকে শয্যা থেকে ওঠাতে গিয়ে দেখেন রাধা মায়ের গায়ে কোন গয়না নেই। -মন্দিরের ভেতরে হৈ হৈ পড়ে গেল। রক্ষীরা তদন্ত করা শুরু করে দিলেন। তখনও কোনো কিনারা হয়নি। সকলেই অনুমান করলেন, রাধা মায়ের গয়না চুরি হয়েছে আর পাওয়া যাবে না। মন্দিরে তখনও গোলমাল চলছে।
-কিছুক্ষণ পর লালাজীর এক সেবক বাইরে আসতেই ছৈয়দ খাঁ সাহেব তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ভাই! মন্দিরের ভেতর এত গন্ডগোল কেন?' শুনে সেই সেবক বললেন, 'রাধা মায়ের গয়না কে যেন চুরি করে নিয়েছে। তাই তদন্ত হচ্ছে।' 'না! না! কোন গয়না চুরি হয়নি।' বলে উঠেন খাঁ সাহেব। এই বলে তিনি কাল রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলে, গয়নার পুটলি সেবকের হাতে তুলে দিলেন। এই কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলেন। মন্দির কতৃপক্ষ ছৈয়দ খাঁ সাহেবের সারা জীবনের জন্য ভোগ প্রসাদ পাওয়ার ও থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখনও বৃন্দাবনে ছৈয়দ খাঁর বাজার এই ঘটনার সাখ্য বহন করে চলেছে।
(শ্রীশ্রী রামঠাকুর কথা প্রসঙ্গে নানা গল্প বলতেন .ভক্তদের কেউ কেউ তা নিজের ভাষায় নোট করে রাখতেন। তরলা সুন্দরী গাঙ্গুলি তাঁদের অন্যতম। এই গল্পটি তাঁর লেখা খাতায় পাওয়া গল্প অবলম্বনে লেখা হয়েছে। লেখিকার উক্তি, 'প্রকৃত ভক্তের উক্ত কাহিনী বিবৃত করে শ্রীশ্রী ঠাকুর গান ধরলেন:
মধুসূদন রোদন মদন ভাতি
বাধব গোবিন্দ মাঝে হস্ত বিরাজিত
(সম্ভবত মাধব বা রাধা)
উদিত ভানু মুদিত তনু দিতেছে অঙ্গে
সদাগান গীত বিনন্দিত।
......গানটির সর্বসাধারণের বোধ্য ভাষা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।' আকর গ্রন্থ শবরী)
উপদেশ: সম্ভবতঃ গল্পটির শেষে শ্রীশ্রী রামঠাকুর এই গানটি গেয়ে ছিলেন তখন কোন উপদেশ দেন নি। তবে সাধারণ মানুষ হিসাবে অনুমান করা যেতে পারে, প্রকৃত ভক্ত যেমন ভাবে ভগবানকে চান, ভগবান তাঁকে তেমন ভাবেই দেখা দেন। যেমন ছৈয়দ খাঁ সাহেব তাঁর মনিব হিসাবে লালাজীকে আকুল ভাবে চেয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধা মা তাঁকে তেমন ভাবেই দেখা দিয়েছিলেন। -মা যশোদা ভগবানকে পেয়েছিলেন পুত্র রূপে।ব্রজগোপীদের কেউ পেয়েছিলেন ননীচোরা রূপে বা নাড়ুগোপাল রূপে।পান্ডব পেয়েছিলেন সখা রূপে। - প্রকৃত ভক্তের কোন জাতি ধর্ম বর্ণ বা ভাষা ভেদ নেই।
রামঠাকুরের বলা গল্প শুনি
সংকলক দীপক কুমার মুখোপাধ্যায় (রঞ্জু)
পৃষ্ঠা:৪৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন