বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫



তুলসীর স্থান
একজন ভক্ত স্নান করে ভেজা কাপড়ে চন্দন মাখা তুলসী নিয়ে ঠাকুরের দিকে এগিয়ে আসেন ঠাকুরকে তুলসী দেবার জন্য। এই দেখে ঠাকুর অনুগ্রহ করে তাঁর চরণ দু-খানি এগিয়ে দিলেন। কিন্তু অশ্রিতটি স্বচন্দন তুলসী পাতা নিয়ে ঠাকুরের বুকের দিকে লক্ষ্য রেখে অগ্রসর হতেই ঠাকুর জিগ্যেস করলেন -
এইগুলি কোথায় দিবেন?
আশ্রিত বৃদ্ধ উত্তর দিলেন- স্বচন্দন তুলসী পত্র বক্ষে দিব। 
ঠাকুর নিজের প্রসারিত পা দু'খানি দেখিয়ে বললেন- তুলসী পত্রের স্থান নারায়নের শ্রীদেহের অন্য কোথাও নাই, এইগুলির স্থান নারায়নের শ্রীচরণে।
ততক্ষণে ঠাকুরের প্রসারিত চরণে স্বচন্দন তুলসীপত্র দিয়ে অশ্রিতটি প্রনাম করলেন। পাশে বসেছিলেন শাস্ত্রী মশায়। এই ঘটনা দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন-
বাবা তুলসী পত্র নারায়নের চরণে দিতে হয় কিন্তু নারায়ণ এদিকে তুলসীকে মালা করে নিজ কন্ঠে ধারণ করে রেখেছেন কেন?
ঠাকুর উত্তরে বললেন, আমি তোমাগরে অনেকবার কইছি। মন দিয়া শোন- তুল কথার অর্থ সম অর্থাৎ সমতুল্য। ভক্ত, ভক্তি, ভগবান তিনরূপে প্রতীয়মান হইলেও মূলত এক, অভিন্ন এবং সমতুল্য। অতএব মূর্তিমতি ভক্তি দেবী তুলসীরূপে সর্বদা নারায়নের চরনাশ্রয় বাঞ্ছা করেন বইলা তুলসী পাতা চরণে দিতে হয়। আর তুলসী নারায়ণ সমতুল্য বইলা নারায়ণ তুলসীর মালা কইরা সাদরে নিজ কন্ঠে ধারণ কইরা একত্বের প্রমান করছেন। ঠাকুর আরও বললেন- অমিত এইসব কথা আপনাগরে অনেক আগে কইছি।


শ্রাবন মাস-বর্ষাকাল। অবিরাম মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে। রাস্তাঘাট জলে পরিপূর্ণ-জনমানবহীন। ঐদিন প্রাতে মাতাঠাকুরানী বলিয়াছিলেন যে ঘরে চাউল নাই। ভাবলাম হাতে একটিও পয়সা নাই, কোথায় টাকা পাই, কথায়ই বা চাউল পাই, ধারই বা এই মাসের শেষে কে দিবে? তারপর ভাবিতে লাগিলাম 'আমি চিন্তা করি কেন? ঠাকুরের উপর নির্ভর করিয়া থাকি তিনি যাহা হয় ব্যবস্থা করিবেন।' এইভাবে মন স্থির করিতে চেষ্টা করিলাম। এমন সময় কিছুদিন পূর্ব্বেকার একটি ঘটনা মনে পড়িয়া গেল।
ঠাকুর তখন ফেনী কলেজের প্রফেসর শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ চক্রবর্তী মহাশয়ের বাসায় আছেন। আমি তথায় সর্ব্বদা ঠাকুরের সঙ্গে আছি। তিন চারদিন বাড়ী যাই না; ভাবিলাম, 'মাতাঠাকুরানী বাজার খরচের কী ব্যবস্থা করিতেছেন একবার গিয়া দেখিয়া আসি।' বাড়ী পৌঁছিবা মাত্রই মা বলিলেন, "বাজার খরচা বাবদ কিছু দিয়া যাস, দুইদিন যাবৎ বাজার করি না।" আমি হাঁ বা না উত্তর না করিয়া সুযোগ বুঝিয়া সরিয়া পরিলাম, কারণ আমার হাতে তখন একটী পয়সাও নাই। প্রমথদাদার বাড়ীতে ফিরিয়া ঠাকুরকে প্রনাম করিলাম। প্রনাম করিতেই আমার দিকে তাকাইয়া ঠাকুর বালিশের তলায় হাত দিলেন ও সেখান হইতে কয়েকটি টাকা বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, 'যান, মাকে এই টাকা কয়টা দিয়া আসেন।' ঠাকুর যে অন্তর্যামী এবং তাঁহার অজানা যে কিছুই নাই তাহা অনুভব করিতে করিতে আমি বাড়ী যাইয়া মাকে টাকা দিয়া আসিলাম।
উক্ত ঘটনা মনে পড়িতেই চাউলের চিন্তা কিছুটা প্রশমিত হইল। হঠাত বাহির হইতে একটা শব্দ আসিল, 'বাবু, চাউল রাখবেন।' বাহিরে তখনও অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে। ভাবিলাম, 'ভুল শুনিতেছি না তো।'; কিন্তু আবার সেই ডাক- 'বাবু, চাউল রাখবেন?'- কৌতূহল পরবশ হইয়া উত্তর করিলাম, 'কে? বাড়ীর ভিতরে এস।' - চাউলের ভাঁড় লইয়া বাড়ীর ভিতরে আসিল জনৈক বৃদ্ধ- বয়স অনুমান ৬০/৬৫ বত্সর হইবে। আমি তাহাকে বলিলাম, 'আমার আতপ চাউলের প্রয়োজন।' সে বলিল, 'আতপ চাউলই আনিয়াছি।' সঙ্গে সঙ্গে সে মোড়ানো কলাপাতা খুলিয়া ফেলিল। বৃদ্ধকে বলিলাম, চাউল আমার পছন্দ হইয়াছে- এখন মাসের শেষ, আমার হাতে টাকা নাই। ইংরাজী মাসের দুই, তিন তারিখের আগে টাকা দিতে পারিব না, আমাকে বাকীতে দিতে হইবে।' সে বলিল 'আমি আপনাকে জানি। এখন টাকা না দিলেও চলবে- মাসকাবারে দিবেন।' সেই মুহুর্ত্তেই চাউলের সমস্যা এইভাবে সমাধান হওয়ায় আমি একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িলাম। শ্রীশ্রী ঠাকুর যে সর্ব্বদাই সঙ্গে সঙ্গে আছেন এবং আমাদিগকে বিপদ হইতে রক্ষা করিতেছেন তাহা বুঝিতে আর বাকী রহিল না।


"শ্রীশ্রী ঠাকুরের সঙ্গে"
শ্রীতুলসীদাস গঙ্গোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী রামঠাকুর আবির্ভাব শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ
পৃষ্ঠা: ১৭২

মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫



এখন যে প্রাণস্পর্শী উপদেশের কথা বর্ণনা করিতে যাইতেছিলাম, তাহারই একটি বিবরণ এখানে সন্নিবেশিত করিবার চেষ্টা করিব। ১৯৪৫ ইংরেজীর ২৮শে ডিসেম্বর তারিখে যে গুরুভগিনীটি ঠাকুরের কৃপা লাভ করিয়াছিলেন, তিনি তাহার স্বামীর সহিত আগরতলা হইতে ডাউন ট্রেনে রাত্রি ৭ ঘটিকার সময় চৌমুহনী আসিয়া পৌছেন এবং স্টেশনে নামিয়াই অন্যান্য দর্শনার্থীদের সহিত আশ্রমে চলিয়া আসেন।
তাহারা শ্রীশ্রী ঠাকুর কে প্রনাম করিয়া কিছুক্ষণ পর সুযোগ বুঝিয়া স্বামী – স্ত্রী দুজনে উঠিয়া আসিয়া ঠাকুরের আসনের কাছে হাত জোড় করিয়া দাড়ান। উক্ত মহিলার স্বামী ইতিপূর্বেই ঠাকুরের আশ্রয় লাভ করিয়াছিলেন। তাই তিনি তাহার স্ত্রীকেও নাম দিবার জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা জানান। ঠাকুর তখন মহিলাটিকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “মা, নাম নিবেন?” তিনি মাথা নাড়িয়া সন্মতি জানাইলে ঠাকুর বলিলেন, আমি ‘নাম’ বলিয়া যাইতেছি, আপনি আমার সাথে সাথে ঐ নাম আবৃত্তি করিয়া যাইবেন।
এই বলিয়া শ্রীশ্রী ঠাকুর চক্ষু মুদ্রিত করিলেন এবং অল্পক্ষণ পরে ছয় অক্ষর যুক্ত নাম মহামন্ত্র উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। মহিলাটিও ঠাকুরের নির্দ্দেশ অনুযায়ী ঐ নাম মহামন্ত্র আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। এই ভাবে অষ্টাদশ বার আবৃত্তি করার পর ঠাকুর থামিয়া অতি আবেগভরে বলিতে লাগিলেন “মা, এই যে নাম পাইলেন ইহার ভিতরে কিন্তু প্রাণ আছে। আপনি ত সন্তানের মা। তাই জানেন যে সন্তান যখন ভূমিষ্ট হয়, তখন তাহার প্রাণের স্পন্দন বুঝা যায় না। ভূমিষ্ট হওয়ার পর ধাত্রী তাহাকে ধুইয়া মুছাইয়া শুকনা কাপড়ে জড়াইয়া নিয়া প্রাণ স্পন্দন দেয়। পরে সন্তান মুখব্যাদান করিলে অতি সন্তর্পণে ভিজা নেকড়ার সাহায্যে মিশ্রিত জল মুখে দেয়। আপনিও তাহার মুখে স্তন হইতে ক্ষীরধারা দেন। এভাবে যত্ন করিতে করিতে শিশু ক্রমে চোখ মেলে, হাত পা নাড়ে, তাহার মুখে হাসি ফোটে। ভূমিষ্ট হওয়ার সময় হইতে মা, শিশুকে যে ভাবে যত্ন করেন, তাহা মন দিয়া করেন না, করেন প্রাণ দিয়া। শিশুর প্রতি মায়ের এই যে টানে যত্ন, সেরূপ যত্ন এই নামের প্রতিও প্রাণ দিয়া করিতে হইবে।
কিছুদিন পর আপনি অতুড় ঘর ছাড়িয়া নিজের ঘর সংসারের কাজে যোগ দেন, সংসারের কাজে যাবার আগে শিশুকে অতি যত্ন ও সাবধানে শোয়াইয়া রাখিয়া যান। এদিকে সংসারের কাজকর্ম করিতে করিতে আপনি কিন্তু সব সময়েই উত্কর্ণ হইয়া থাকেন – কখন বুঝি বা শিশু কাঁদে, এই যে উত্কর্ণ হইয়া থাকা, এখানেও প্রানের টান। ঠিক এইভাবে যখন আপনি সংসারের কাজকর্ম নিয়া থাকিবেন, নামের প্রতিও ঠিক একইভাবে আপনার প্রাণের টান থাকিবে। মনে রাখিবেন এই সংসার গোপালের সংসার, যা কিছু সংসারের কাজ সবই গোপালের কাজ।
গোপাল ক্রমে হাঁটিতে শিখিলে যশোদা মা হাততালি দিয়া তাকে আঙ্গিনায় নাচাতেন এবং গোপালের নাচ দেখিয়া মা আনন্দে ভরপুর হইতেন। এই নামরূপী গোপালও আপনার যত্নে ক্রমে চেতনামুক্ত ও শক্তিশালী হইয়া আপনার হৃদয় আঙ্গিনা আলো করিয়া নাচিতেছেন, অনুভূতিতে জানিতে পারিবেন এবং যশোদা মায়ের ন্যায় আপনিও সেই অনুভূতিতে আনন্দে আত্মহারা হইবেন। ইহাই নিত্যানন্দের যোগ।
যশোদা মার ‘গোপাল’ ইতক্রমে বড় হইয়া মথুরার রাজা হইয়াছিলেন। তখন তাহার নাম হইয়াছিল ‘গোবিন্দ’।
আপনার নামরূপী গোপালকে প্রাণ দিয়া যত্ন করিতে করিতে ক্রমে গোবিন্দ রূপে, – বিশ্বের রাজা রূপে জানিতে পাইবেন। গো-ব্রহ্ম সত্য। বিদ্-জানা। গোবিন্দ-আনন্দ, সত্যকে জানা।”
শ্রীশ্রী ঠাকুর যেরূপ আবেগের সহিত কথাগুলি বলিয়া গেলেন, তাহাতে নামপ্রাপ্তা গুরুভগিনীটির প্রাণে এমনই সাড়া আসিল যে, তিনি আর অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলেন না। দর্দর্ করিয়া প্রেমাশ্রু তাহার গন্ডদ্বয় বহিয়া ঝরিতে লাগিল। শুধু তিনি নন, সেদিন এই নাম দিবার সময়ে ঠাকুরের আসনের সন্নিকটে আমরা যে কয়েকজন উপবিস্ট ছিলাম, কেহই অশ্রু সম্বরণ করিতে পারি নাই। ধন্য আমার এই ভাগ্যবতী গুরুভগিনী। ঠাকুরের কৃপায় ইস্টস্মৃতিতে ক্ষনিকের মধে সচ্চিনানন্দ সাগরে ডুবিয়া ধন্য হইলেন। এই ইস্টস্মৃতি তাহার হৃদযে চিরদিন জাগরুক থাকিবে, আমার এই আন্তরিক বিশ্বাস। দুঃখের বিষয় উক্ত নামপ্রাপ্তা গুরুভগিনীটির নাম জিজ্ঞাসা করার কথা তখন মনে জাগে নাই, তাই এখানে তাহার ও তাহার স্বামীর নাম উল্লেখ করিতে পারিলাম না।


- শ্রীশ্রী রামঠাকুর কথামৃত বিন্দু
শ্রী ব্রজেন্দ্র কুমার চৌধুরী
পৃষ্ঠা: ৫৫


এই ঘটনাটি ঘটিয়াছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম চিরতরে বাকরুদ্ধ হইয়া যাওয়ার অল্প কিছুদিন পূর্বে। সময় কালে দশটা কী সাড়ে দশটা হইবে কাজী সাহেব আর্লস্ট্রিটে কুঞ্জ বাবুর গৃহের এক তলার ঘরে প্রবেশ করিলেন। তখন কুঞ্জ মজুমদার মহাশয়ের বাড়ীর এক তলায় সপরিবারে বাস করিতেন সদানন্দ চক্রবর্তী মহাশয়। কবিকে দেখিয়া সদানন্দবাবু করজোড়ে আহ্বান করিয়া তাঁহার বৈঠকখানায় নিয়া বসাইলেন। কবির হাতে একটি থলে দেখিয়া সদানন্দদা অনুমান করিলেন হয়ত বাজার করিতে বাহির হইয়া, তিনি এইখানে চলিয়া আসিয়াছেন। খেয়ালি কবির ভাবসাব তাঁহার ভালই জানা ছিল। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের গৃহে যাতায়াতের সময় সদানন্দবাবুর সহিত কবিবরের আলাপ পরিচয় ঘটে। শুধু তাহাই নহে সেই সময় তাঁহাকে কয়েকবার কাজী সাহেবের বাসা বাড়ীতেও যাইতে হইয়াছিল। কবিকে বসিতে দিয়া সদানন্দবাবু বলিলেন, 'কাজীদা কী মনে করে আমার মত দীন হীনের ঘরে আগমন।'
-'রাজা যদি হীন, প্রজা হয় দীনের দীন। তুমি না রামঠাকুরের ভক্ত শিষ্য, দীন হতে যাবে কেন। তুমি তো দীন দুনিয়ার রাজার প্রজা। দাওনা একবারটি দর্শন করিয়ে। শুনলাম মজুমদার মশায়ের ঘরে রামঠাকুর মশায় সশরীরে আছেন।'
কবির কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু বিনয়ের সহিত কহিলেন, 'কাজীদা আজই আপনি আসার ঘন্টা খানেক আগে প্রধান মন্ত্রী হক সাহেব (তখন অখন্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধান মন্ত্রী বলা হইত) এসে ঠাকুরের দর্শন কামনা করেছিলেন। ঠাকুর মশায় তাঁকে দর্শন দেন নি এই বলে-"রাজা উজিরদের এই দরিদ্র ব্রাহ্মণের কাছে কোন দরকার আছে বইল্যা তো আমার জানা নাই।" লোক মারফৎ কথাটি শুনে হক সাহেব চলে যান।
কথাগুলি শুনিয়া নিরাশ হইলেন কবিবর। সদানন্দবাবু কাজীদার প্রিয় আহার্য্য চা এবং পানের ব্যবস্থা করিলেন। চা পান তখনও শেষ হয় নাই এমন সময়ে উপর হইতে একজন আসিয়া বলিলেন, 'এখানে কে একজন মুসলমান কবি এসেছেন তাঁকে ঠাকুর যেতে বল্লেন।'
কাজীদা মুহুর্ত্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া সদানন্দবাবুর দিকে একবার ছল ছল নেত্রে চাহিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন। সদানন্দদাও তাঁহার পিছনে পিছনে গেলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরকে দর্শন ও প্রনাম করিয়া অঞ্জলিবদ্ধ দুই হাত পাতিয়া ঠাকুরের শ্রীমুখ পানে মিনতি ভরা নয়নে চাহিয়া রহিলেন। মুখে কিছুই বলিলেন না। কবির করুন দৃষ্টিপূর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া, "এ জন্মে নয় পরের জন্মে হইব।" এই বলিয়া ঠাকুর চুপ করিয়া গেলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের কথা শুনিয়া বিদ্রোহী কবি ঠাকুরকে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করিয়া হাঁটু মুড়িয়া দুই হাত জোড় করিয়া তখন একটি গান গাহিতে লাগিলেন।
এই প্রেক্ষিতে সদানন্দদা বলিলেন যে তত্খনাত রচিত গানের ভাষা এবং সুর এতই হৃদয় বিদারক ছিল যে উপস্থিত সকলের চোখের জল ঝরিতে লাগিল। আর দেখা গেল গান গাহিতে গাহিতে বিদ্রোহী কবির দুই নয়নের অশ্রুধারা। অন্যদিকে তখন শ্রীশ্রী ঠাকুর স্থির অচঞ্চল অবস্থায় যেন ধ্যান মগ্ন। সদানন্দদা আরও জানালেন যে উক্ত ঘটনার কিছুদিন পরে তাঁহারা জানিতে পারিলেন যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ হইয়া গিয়াছেন।



ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা:৩৬৬

''আমিই সত্যনারায়ণ! আমিই সত্যনারায়ণ! শত ধারালো অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হইলেও আপনাদের কিছুই হইবে না।"


ঠাকুর তখন চৌমুহনীতে। তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা চরিতেছে। হঠাত একদিন শুনিলাম যে ঠাকুর ফেনীতে প্রমথদাদার বাসায় আসিয়াছেন। ততক্ষনাত গিয়া ঠাকুর দর্শন করিয়া প্রনাম করিলাম। ঠাকুর তখনই বালিশের তলা হইতে গোটাবারো টাকা লইয়া আমাকে দিয়া বলিলেন, 'এই টাকা দিয়া সত্যনারায়ণ পূজার আয়োজন করেন। আজ সন্ধ্যায় আপনিই পূজা করবেন।'
শুনিয়া আমি তো অবাক! কেননা সন্ধ্যাপুজা দূরের কথা, গায়ত্রী মন্ত্রও আমি ভাল করিয়া উচ্চারণ করিতে পারি না। আমি কী পূজা করিব? তাছাড়া পন্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত শরৎ কাব্যতীর্থ মহাশয় ঠাকুরের নিকট বসিয়া আছেন। তাঁহাকে পূজার ভার না দিয়া আমাকে কেন পূজা করিতে বলিলেন তাহার কারণ অনুধাবন করিতে পারিলাম না।
ঠাকুরের আদেশানুযায়ী ঐদিন সন্ধ্যায় তাঁহার আশীর্ব্বাদ লইয়া যে ঘরে ঠাকুরের শ্রীপট আছে সেখানে যাইয়া পূজায় বসিলাম, আঙ্গিনায় কীর্ত্তন চরিতে লাগিল। কোন প্রকারে পূজা শেষ করিলাম। বহু লোকের সমাগম হইয়াছিল, তাহারা প্রসাদ পাইয়া চলিয়া গেল। তারপর ফুল চন্দন লইয়া ঠাকুরের শ্রীদেহ পূজা করিবার মানসে ঠাকুরঘরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম ঠাকুর স্থিরাসনে, দেহ জ্যোতির্ম্ময়, ঘরটী সৌরভে ভরা। আমি শ্রীপদে পতিত হওয়া মাত্র বলিতে লাগিলেন, ''আমিই সত্যনারায়ণ! আমিই সত্যনারায়ণ! শত ধারালো অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হইলেও আপনাদের কিছুই হইবে না।"
ঠাকুরের লীলা সম্পর্কে কিছু লিখা আমার সাধ্যাতীত। তাঁহার সন্নিধানে থাকিয়া দীর্ঘদিন তাঁহার পদসেবা করিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল। তাঁহার পদপ্রান্তে বসিয়া কত কথা শুনিয়াছি, কত অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়াছি, কত আনন্দে দিন কাটাইয়াছি। ইহা বুঝিয়াছি যে তাঁহার সম্পর্কে কিছু লিখা আর না লিখা উভয়ই ভুল।



"শ্রীশ্রী ঠাকুরের সঙ্গে"
শ্রীতুলসীদাস গঙ্গোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী রামঠাকুর আবির্ভাব শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ
পৃষ্ঠা: ১৭২


"মন্ত্র" "নাম" "নাম করা" "নাম সংকীর্তন" কাহাকে বলে?


বেদবানী ২য় খন্ড ১৩২ নং পত্র
"প্রাণ অর্থাৎ যাহা শ্বাস-প্রশ্বাস চলিয়া থাকে, ইহাই ভগবান। ইহাকেই স্থির করিয়া যতটুকু সময় রাখা যায় ততটুকু সময়ে ভগবানের নাম করা হয় এবং ইহার স্থির অবস্থায় নিবার জন্য মনের যে বেগ তাহারই নাম মন্ত্র। যখন এই প্রাণেতে স্থির বুদ্ধি অর্থাৎ প্রাণ স্থির বোধ হইবে তাহাকে স্থির আত্মা বলিয়া জানিবেন। অতএব যত সময় পারেন ঐ প্রানের স্থির করিবার জন্য চেষ্টা করিবেন, এই অনুষ্ঠানের নামই নাম করা, অর্থাৎ এই স্থিরের অধীন থাকার নামকে নাম বলে। .....সকল অবস্থাতেই এই ভূত প্রকৃতি মুক্তির জন্য এই প্রানের স্থির করার আশ্রয় নিয়া [থাকিবেন] এই প্রানের স্থির বৈ আর কিছুই নাই এই জ্ঞানকে নাম সংকির্ত্তন বলিয়া জানিবেন।"
শ্রীশ্রী ঠাকুরের ১৩২ নং পত্রখানা এবং তত্পূর্ব্বে লিখিত নামের উপদেশ পূর্ণ অন্য পত্রগুলির সারমর্ম্ম আমাদের অন্তরে ধারণ করিতে পারিলে নামের সেবা দ্বারা নামের কৃপা লাভ করিব ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।
তবে যদি কেহ তাঁহার বাণীতে সন্দিহান হন তবে মুণ্ডকোপনিষদে ঋষিগণ নাম জপের যে উপদেশ দিয়াছেন তাহা অনুধাবন করিয়া দেখিবেন যে ঠাকুরের বাণী ও উপনিষদের উক্তিতে কোন পার্থক্য নাই।
প্রনবো ধনুঃশরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তনময়ো ভবেত।
মুণ্ডকোপনিষদ ২/২/৪

তির, ধনু, লক্ষ্যবস্তু এই তিন বস্তুর চিন্তা করিয়া এই শ্লোকটি আস্বাদন করিতে হইবে।
ধনু= প্রণব, অম, নাম।
তির= প্রাণ
লক্ষ্য বস্তু =পরমাত্মা, সত্য, ব্রহ্ম।
যখন প্রাণ স্থির বোধ হইবে তাহাকে ঠাকুর স্থির আত্মা বুঝাইয়াছেন। স্থির আত্মাই পরমাত্মা ইহাই লক্ষ্যবস্তু।
ব্যাধ তাহার লক্ষ্যবস্তু পাখীকে বিদ্ধ করিতে হইলে ধনুতে তির সংযোগ করিয়া পাখীর প্রতি তন্ময় হইয়া তীর নিক্ষেপ করিলে পাখী বিদ্ধ করিতে পারে। সাধক এখন ব্যাধের মত প্রাণপাখী অর্থাৎ পরমাত্মার সঙ্গে আবদ্ধ হইতে হইলে নাম ধনুতে "প্রাণ" শর সংযোগ করিয়া তন্ময়তা আনিতে পারিলেই লক্ষ্য বস্তু লাভ করিবেন; ইহাই নাম ধনুতে প্রাণ শর দিয়া ব্রহ্মকে বিদ্ধ করা। নামকে প্রানের সঙ্গে যুক্ত না করিয়া সাধক কখনও লক্ষ্যবস্ত্তুতে পৌঁছিতে পারে না।
কলিযুগে সত্যনারায়নের সেবায় সত্যপীঠ অর্থাৎ আসনটি সত্যের প্রতীক, ধনু হইল নাম, তীর হইল প্রাণ; এই তিন সংযুক্ত করিয়া দেওয়া হয়। ইহার তাত্পর্য্য এই যে নাম প্রানের সঙ্গে যোগ করিয়া নাম করিতে রুচি, তন্ময়তা আসে। নাম, প্রাণ এবং তন্ময়তা এক তিনের যোগ হইলেই সত্যপদ ছাড়া হয় না। ইহাই জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ, ও ভক্তিযোগের মর্ম্মার্থ। যোগ দ্বারাই যোগেশ্বররেশ্বর গোবিন্দ প্রাপ্তি হয়।
সত্যনারায়ণ ব্রতে যে সিন্নি দেওয়া হয় তাহা জীবনের ভাগ্যের ভোগ নিবেদন- ভোগদান করিতে করিতে দানের অর্থাৎ ভাগ্যের আর যখন কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না- তখনই সত্য অর্থাৎ মহাপ্রসাদ প্রাপ্তি হয়। ইহাই শ্রীশ্রী ঠাকুরের আচরিত, প্রচারিত "সত্যনারায়ণ ব্রত" সত্যব্রত, পতিব্রত।

শ্রীশ্রী রাম পূজা (শ্রীশ্রী রামঠাকুর প্রসঙ্গে)
ডাঃ শ্রীযতীন্দ্র চন্দ্র দেব রায়

সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫


পূর্ণ ব্রহ্ম সনাতন, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় কারণ, সত্যনারায়ণ, আমিই সেই রামঠাকুর।


তিরিশ দশকের প্রারম্ভে ঢাকা হইতে সদানন্দকে সঙ্গে লইয়া ঠাকুর মহাশয় আসিলেন পূর্ববঙ্গের ভৈরব ষ্টেশনের রেল আবাসনে। সেখানে শ্রীযুক্ত ললিত রায় মহাশয়ের আবাসে শ্রীশ্রী রামঠাকুর শুভবিজয় করিতেছেন। প্রতিদিন বিশেষ করিয়া ছুটির দিন সকাল সন্ধ্যায় অপেক্ষাকৃত অধিক ভক্তকূল শ্রীশ্রী ঠাকুর সন্নিধানে আসিয়া তাঁহার অমৃতময় কথা শ্রবণ করিয়া আনন্দ লাভ করিতেছেন। রেল আবাসন এবং আশপাশের আশ্রিত অনাশ্রিত নির্ব্বিশেষে ধর্ম্মপিপাসু ভক্ত সমাজে শ্রীশ্রী ঠাকুরের শুভাগমনে সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। স্ত্রীপুরুষ সকলে শ্রীশ্রী ঠাকুরকে দর্শন ও প্রনাম করিতে ব্যস্ত। কেহ কেহ নাম চাহিয়া নাম পাইতেছেন।
ললিত রায়ের গৃহের চারিদিকে যেন আনন্দের হাট বসিয়াছে। এইভাবে একদিন সকাল বেলায় জাতিতে ব্রাহ্মন, স্থানীয় একজন তথাকথিত পন্ডিত শ্রেনীর ব্যক্তি ললিত রায় মহাশয়ের গৃহবাসের সম্মুখে আসিয়া পান্ডিত্যের গৌরবে গর্বিত হইয়া পন্ডিত উচ্চ কন্ঠে বলিতে লাগিলেন, "কৈ গো তোমাদের রামঠাকুর, তিনি নাকি ভগবান, তাঁরে একবার দেইখা যাই।"
অহঙ্কারী পন্ডিতের শ্লেষপূর্ণ বাক্য শুনিয়া সেখানে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত। গৃহ মধ্যে ভক্ত পরিবৃত হইয়া ঠাকুর মহাশয় একখানা তক্তপোষের উপর তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বসিয়া আছেন। উদ্ধত পন্ডিতের কথা শ্রবণ করিয়া শ্রীশ্রী ঠাকুর শান্তভাবে বাহিরে আসিয়া সেই পন্ডিতের সম্মুখে দন্ডায়মান পূর্বক তাহার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া উদাত্ত কন্ঠে বলিতে লাগিলেন, -

"পুর্ণব্রহ্ম সনাতন, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় কারণ, সত্যনারায়ণ, আমিই সেই রামঠাকুর।"
পান্ডিত্যের অহঙ্কারে অহঙ্কারী পন্ডিত প্রবর কথাগুলি শুনিতে শুনিতে শ্রীশ্রী ঠাকুরের মধ্যে কী দেখিতে পাইলেন তাহা তিনিই জানেন। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ কিছুই অনুমান করিতে পারিলেন না। তাঁহারা শুধু লক্ষ্য করিলেন সেই আত্মাভিমানী গর্বিত পন্ডিত মুহুর্তের মধ্যে থর থর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভূপাতিত হইলেন। তখন উপস্থিত সকলের মধ্যে চঞ্চলতা শুরু হইয়া গেল। কেহ কেহ তাঁহার শুশ্রুষায় ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। চোখে মুখে শিরে জলক্ষেপনপূর্বক তাঁহাকে সকলে ধরাধরি করিয়া যে ঘরে ঠাকুর মহাশয় আছেন সেখানে ঘরের মেঝেতে শোয়াইয়া দিলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর পুনরায় তাঁহার পূর্ব নির্দ্দিষ্ট আসনে বসিয়া নির্লিপ্তের ন্যায় সব কিছু অবলোকন করিয়া যাইতেছেন। কিছুক্ষণ পরে পন্ডিতের সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল। জ্ঞান ফিরিবার পরে দাম্ভিক পন্ডিত শ্রীশ্রী ঠাকুরের সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিলেন। তারপর হাতজোড় করিয়া কম্পিত কন্ঠে ঠাকুরের শ্রীমুখপানে চাহিয়া সাশ্রুনয়নে গীতার একাদশ অধ্যায় আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। সদানন্দদা বলিলেন যে গীতার একাদশ অধ্যায় বিশ্বরূপ দর্শন সম্পূর্ণ আবৃত্তি করিতে মুহুর্মুহু কাঁপিয়া উঠিতেছিলেন। তখনও পর্য্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে পারেন নাই। যতক্ষণ তিনি গীতার শ্লোকগুলি পাঠ করিতেছিলেন, ঠাকুরমহাশয় তাঁহার আসনে স্থির ভাবে বসিয়াছিলেন। আবৃত্তি শেষে ব্রাহ্মণের অবস্থা দেখিয়া ঠাকুর বলিলেন, "ওনারে একটু গরম দুধ খাওয়াইয়া বাড়ি পৌঁছাইয়া দেন। একটুকু বিশ্রাম করলেই ঠিক হইয়া যাইব।"
 উপরি উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সদানন্দ চক্রবর্তী মহাশয় ঐ কাহিনী বলিবার পরে তিনি শ্রীশ্রী ঠাকুরের মহিমা মন্ডিত আরও একটি বিষয়ে আলোকপাত করিয়াছিলেন। এই ললিত রায়দের বংশের একটি বালককে দত্তক নিয়েছিলেন জনৈক চট্টোপাধ্যায় মহাশয়।
তাঁহার কোন সন্তানাদি ছিল না। বহুদিন আগের কথা সদানন্দবাবু ওই চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের নাম স্মরণ করিতে পারিলেন না। চ্যাটার্জি মহাশয় ছিলেন গুরুকৃপাধন্য এক ব্যক্তি।
আর্থিক অবস্থা তাঁহার ভালই ছিল। কিন্তু প্রারব্ধ দন্দভোগ তাঁহার এতই প্রবল ছিল যে ঠাকুর মহাশয় স্বয়ং চ্যাটার্জিবাবুর জন্য চিন্তাযুক্ত থাকিতেন। চিন্তিত ঠাকুর মহাশয়কে তাঁহার গুরুদেব চ্যাটার্জিবাবুর নাম উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন, "রাম, অমুকের চিন্তা তোমাকে করিতে হইবে না, তাহার ভার আমি নিলাম।"
এইরূপ বলিয়া গুরুদেব একটি রুদ্রাক্ষের মালা ঠাকুরের হাতে দিয়া বলিয়াছিলেন, "তাহাকে এই রুদ্রাক্ষের মালায় নাম জপিতে বলিবে।" শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁহার গুরুদেবের কথানুযায়ী তাহাই করিয়াছিলেন। কিছুদিন পরে পরম গুরু অর্থাৎ ঠাকুরের গুরুদেব পুনরায় ঠাকুরকে বলিয়াছিলেন, "তাহার আর রুদ্রাক্ষের মালা জপের প্রয়োজন নাই।"
অনেক পরে শ্রী প্রমথ চক্রবর্তী, শ্রীযুক্ত শ্রীমন্ত কুমার বনিক, শ্রীসদানন্দ চক্রবর্তী প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ যখন যাদবপুর কৈবল্যধামের ট্রাষ্টি বোর্ড সদস্য, তখন তাঁহারা সকলে মিলিয়া শ্রীশ্রী ঠাকুরের গুরুদেব প্রদত্ত রুদ্রাক্ষের মালা খানা সংগ্রহ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল পরমগুরুদেবের নিদর্শন স্বরূপ বহুমূল্যবান উক্ত রুদ্রাক্ষের মালখানা যাদবপুর আশ্রমের সংগ্রহ শালায় রাখিবেন।
কিন্তু তাঁহাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হইল। প্রকারান্তরে তাঁহারা জানিতে পারিয়াছিলেন যে জনৈক অমিয় রায়, যিনি দাদাজী নাম নিজেকে প্রকাশ করিতেন, তিনি মালখানা পূর্বাহ্নেই হস্তগত করিয়া ফেলেন। তাঁহাকে অনেক অনুনয় বিনয় করিয়াও ট্রাষ্টিবোর্ডের সদস্যগণ, পরমগুরুর পবিত্রস্পর্শ প্রাপ্ত রুদ্রাক্ষের মালখানা পাইতে সমর্থ হন নাই। 


ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা: ৩১২

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫


"মনের দ্বারা যে ভালবাসা আহরণ হয় তাহা ভালবাসা থাকে না। কারণ সেটি মাত্র দেহ প্রবর্ত্তন থাকে। কিন্তু ঘুমাইলে কেহ থাকে না। দেহ মন বুদ্ধি [?] ধন জন বৈভবাদি অহংকার কিছুই থাকে না। এই অবস্থাকে অহেতুকী ভালবাসা হেতুবর্ত্ত দেহের ভালবাসা থাকে না। এই অবস্থা হইল প্রেম। দেহের দেহীর প্রেম হয় না ভালবাসা ও সেই রকম। চন্ডীদাস রামীর ভালবাসায় ইন্দ্রিয় ছিল না। তুলসীদাসের যে ভালবাসা সেটি অতিন্দ্রিয়। ইহাই দুই প্রকৃতির ভালবাসা কিন্তু মনের নয়। জাগিয়া মনের দ্বারা ভালবাসা যাহা ঘটে তাহাতে ঋণ পাশে বন্দী হয়। স্বাভাবিক ভালবাসা যেমন বালক বালিকার অহেতুকী ভালবাসা তাতে কোন ইন্দ্রিয়ের যোগ নাই জানিবেন। ব্রজগোপীর ভালবাসা সেইরূপ অবিচ্ছেদ জানিবেন। স্বপনে জাগরণে সুষুপ্তিতে ভালবাসা বিলোপ হয় না। যখন আপনার বুদ্ধি মন সকল হইতে উদ্ধার হইবে তখনই। তখনই সমস্তের মিমাংসা আপনে হইবে জানিবেন। সত্যং পরং ধীমহি। সত্যের বিয়োগ নাই। অসত্যের কখন যোগ হয় না। যখন অহেতুকী ভালবাসা মিলে তখন দেহ বোধ থাকে না। বর্ত্তমানে কাম আত্মা ভালবাসা ইহা সকলি স্বার্থপর ভালবাসা।"

বেদবাণী:৪/৩১

 
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে সদানন্দ চক্রবর্তী দর্শন শাস্ত্রে এম.এ পাশ করিলেন। মধ্য কলিকাতার বাসা ছাড়িয়া আসিলেন ভবানীপুর অঞ্চলে গৌরভক্ত মিত্র পরিবারের বাসগৃহের একাংশে। মিত্রপরিবারের একজন জ্যোত্স্নাবাবুর সহিত সদানন্দবাবুর বন্ধুত্বের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছিল। সদানন্দবাবু যখন মধ্য কলিকাতার আবাস ছাড়িয়া অন্যত্র বাসাবাড়ি অন্বেষণ করিতেছিলেন তখন জ্যোত্স্নাবাবু এবং তাহার পরিবারের অন্যরা সদানন্দবাবুকে তাঁহাদের বাসগৃহে থাকিতে অনুরোধ করিলে তাঁহাদের আন্তরিক আহ্বান তিনি উপেক্ষা করিতে পারিলেন না।
সমূহ বাসস্থানের সমস্যা এইভাবেই সমাধান হইল। এইবার কর্মজীবনের পথ নির্ব্বাচনের ভাবনায় তিনি ভাবিত। কারণ বহুদিন ধরিয়া তিনি হৃদয়ে সযত্নে লালন করিয়া আসিতেছেন যে পরের বাঁধাধরা চাকুরী করিবেন না। কিন্তু কিছু একটা উপার্জনের রাস্তা বাহির করিতে হইবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একবার শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, "সংসারে সাধারনভাবে থাকিতে গেলেও একটা কিছু করিতে হয়।" যে সময় ঠাকুরমহাশয় এই উক্তি করিয়াছিলেন তখন উভয়ের মধ্যে যে কথোপকথন হয়। -
ঠাকুর: আপনি ওকালতি পড়েন।
সদানন্দ: ওকালতি আমার দ্বারা হইবে না। কারণ ওকালতি করিতে অনেক মিথ্যা বলিতে হয়।
ঠাকুর: মিথ্যা কথা না বইল্যাও ওকালতি করা যায়।
সদানন্দ: ওকালতিতে তাহাসম্ভব হয় না।
ঠাকুর: আচ্ছা ওকালতি না করিতে পারেন, পুলিশে চাকরী নেন গিয়া। তবে আপনাকে আইন আদালতের কাজ কিছু করতেই হইব।
বাস্তবিকই সদানন্দবাবুকে তাঁহার জীবনের কিছু সময় আইন আদালতের কাজে সংযুক্ত থাকিতে হইয়াছিল।
সে যাহা হউক, তখন ঠাকুরের শ্রীমুখে পুলিশের চাকুরী কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু বলিলেন, "ঠাকুর মশায় একবার আপনিই তো আমাকে বলিয়াছিলেন, এল, এ, বি, এ পাশ করিয়া কী হইবে সেই ত কোন অফিসে বড় কর্ত্তার অধীনে জো হুজুর, জো হুজুর করিবেন।"
সদানন্দবাবুর এক কথার উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেন, "সংসারে সাধারণ ভাবে থাকিতে গেলেও একটা কিছু করিতে হয়।"
তারপর ঠাকুরের কথায় তিনি একবার পুলিশের চাকুরীর চেষ্টাও করিয়াছিলেন।তাহাতে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে একটি পদের নিয়োগ পত্রও পাইয়াছিলেন। চাকুরীর চিঠি হাতে আসিলে তাহা পড়িয়া তত্ক্ষনাত ছিড়িয়া ফেলিলেন।
এইভাবেই কর্ম জীবনের প্রারম্ভে সদানন্দবাবুর টানা পোড়ান চলিতেছিল।এমন সময়ে আকস্মিক ভাবে সদানন্দের সহিত ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। অতীতে নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা কংগ্রেস দলের স্বনামধন্য নেতা শ্রীসত্যেন্দ্র চন্দ্র মিত্র মহাশয় সদানন্দকে লইয়া ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় মহাশয়ের গৃহে আসিলেন। ডাক্তার রায়ের সহিত পরিচিত হওয়া না হওয়ার কোনরূপ ইচ্ছাই সদানন্দবাবুর ছিল না। মিত্র মহাশয় স্বয়ং কী মনে করিয়া ডাঃ রায়ের বাস ভবনে তাহাকে সঙ্গে লইয়া গেলেন। কংগ্রেসের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দুইজন নেতার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া নানা কথাবার্ত্তা চলিতেছিল।অদূরে সদানন্দ চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। ডাঃ রায় তাঁহাদের কথার মাঝে মাঝে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন।এইরূপে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়া যাওয়ার পর তাঁহাদের কথোপথনের অবসান হইলে ডাঃ রায় মিত্র মহাশয়কে প্রশ্ন করিলেন, "এই ছেলে টি কে, কোন চাকুরীর ফিকিরে এসেছে নিশ্চয়ই।" তাহার উত্তরে মিত্র মহাশয় বলিলেন, "একেবারেই তা সত্য নয়। আমি যতদূর জানি এই ছেলেটির চাকুরী করার কোন ইচ্ছাই নেই। আমি নিজেই ওকে সঙ্গে করে এখানে এনেছি। ছেলেটি অতিমাত্রায় সৎ, কর্মনিষ্ঠ এবং বুদ্ধিমান। বিশেষ করে আমি যতদূর বুঝেছি এর একটি বড় গুন এই বয়সেই সে ঈশ্বর সন্ধানী। এমন একটি ছেলে কোন কাজে লাগতে পারে ভেবেই তোমার কাছে নিয়ে আসা।কলিকাতায় সে সম্পূর্ণ একাই থাকে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সমূহ বেকার।"ডাঃ রায় সব শুনিয়া সোজাসুজি সদানন্দকে বলিলেন, "পরে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করো।" তিনদিন পরে সদানন্দবাবু দ্বিতীয়বার আসিলেন ডাঃ রায়ের গৃহে। ডাঃ রায়ের সহিত সাক্ষাত হইতেই তিনি বলিলেন, "তুমি তিনদিন পরে এলে, পরের দিনিই কেন এলে না। "
গত তিন দিন ব্যাপী কলিকাতা হাইকোর্টে কিছু কাজে সন্ধানে তাহাকে ব্যস্ত থাকিতে হইয়াছে। সকাল এবং সন্ধ্যার পরে প্রাইভেট টিউশানি তো ছিলই। কিন্তু ডাঃ রায়ের কথা শুনিয়া তিনি মনে মনে ভাবিলেন, 'পরে দেখা করো' এই কথার অর্থ যে পরের দিনিই তাহাতো বুঝি নাই। কিন্তু ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন রাশভারি ডাঃ রায়কে তাহাতো বলা যায় না। তাই বলিলেন, "দেখুন কলিকাতায় আমি একা থাকি। থাকা,খাওয়া, চলা ফেরা ইত্যাদির জন্য আমাকে কয়েকটি ছাত্র পড়াতে হয় এবং কর্ম্মের সন্ধানেও থাকতে হয় তাই সময় করা যায়নি।"
সদানন্দবাবুর কথা শুনিয়া ডাঃ রায় বলিলেন, "তোমার মাসে কত টাকা হলে খরচ খরচা মিটে যায়?"
-এই তিরিশ টাকার মত হলেই প্রয়োজন ফুরায়ে যায়।
-"তুমি তাই পাবে আমার কিছু ব্যাক্তিগত কাজ কর্ম তোমাকে করতে হবে। তোমাকে রোজই একবার আসতে হবে। তবে কোন নির্দ্দিষ্ট সময় না হলেও চলবে।"
সেই হইতে সদানন্দবাবুর যাতায়াত শুরু হইল ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের গৃহে।প্রথমে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন।কারণ ডাঃ রায় বলিয়াছেন তাঁহার কিছু ব্যক্তিগত কাজ তাহাকে করিতে হইবে। কি এমন ব্যক্তিগত কাজ যাহা তাহাকে করিতে হইবে? কিন্তু পরে তাহার সেই শঙ্কা কাটিয়া যায়। ডাঃ রায় গোপনে দুঃস্থ ব্যাক্তিদের অর্থ সাহায্য করিতেন। ঐ সকল দান-ধ্যানের কথা ওপরে জানুক ইহা তাঁহার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নহে। দুঃস্থ বলিতে যেমন যাঁহারা সমাজের নামী, জ্ঞানীগুনিজন অথচ আর্থিক অনটনে দুঃসহ অবস্থায় আছেন। অপরের নিকট হাত পাতিয়া কিছু লইতেও তাঁহাদের সম্ভ্রমে বাধে। এমন অনেক পরিবারকে ডাঃ রায় গোপনে এমনভাবে সাহায্য করিতেন যাহাতে তাঁহাদের সম্মানহানি না ঘটে। তাহা ছাড়া গরিব দুঃখী এবং কোন কন্যাদায়গ্রস্থ ব্যাক্তি, মন্দির, মসজিদ নির্মান কল্পে অর্থ সাহায্য ডাঃ রায় নিয়ত গোপনেই করিতে চেষ্টা করিতেন। সাধারণত এই সকল কাজ যাহার মাধ্যমে করিতে হয় তাহাকে একান্ত ভাবেই সৎ এবং বুদ্ধিমান হইতে হয়। সদানন্দবাবু ক্রমে ক্রমে ডাঃ রায়ের সেই বিশ্বাস অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
পরে এমন হইয়াছিল যে সদানন্দ ডাঃ রায়ের একান্ত আপন জনের মত তাঁহার পরিবারের একজন হইয়া গিয়াছিলেন।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের কথা বলিতে যাইয়া কোন কথায় আসিয়া পরিলাম এই ভাবিয়া প্রিয় ভক্ত পাঠক বৃন্দ আপনারা হয়ত অধৈর্য্য হইয়া উঠিয়াছেন। শ্রীশ্রী রামঠাকুরের সঙ্গে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের যে একটি যোগাযোগ সুত্র ছিল, এই সত্যটি ডাঃ রায়ের জীবন কথায় ছিল সম্পূর্ণ উহ্য। এই বিষয়টি সদানন্দবাবুর অনুমান সাপেক্ষে হইলেও তাঁহার দৃঢ় ধারণা ছিল এই সম্বন্ধে। কীরূপে তাঁহার এইরূপ দৃঢ় ধারণা হয় সেই কথাটি বলার চেষ্টা করা হইতেছে -
সদানন্দবাবুর কাছে জানিলাম ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের অমৃতি-প্রীতি ছিল। রাত্রিতে খাওয়ার পরে শয়নে যাইবার পূর্বে একটি অমৃতি খাইতেন তিনি। এবং তত্সঙ্গে একান্ত অন্তরঙ্গ জনেদের লইয়া কিছুক্ষণের জন্য হালকা আলোচনার আসর বসাইতেন। সেই গল্পগুজবের আসরে যাহারা উপস্থিত থাকিতেন প্রত্যেককে অমৃতি পরিবেশন করা হইত। ডাঃ রায় একখানা অমৃতিই খাইতেন। কিন্তু তাঁহার নির্দেশে উত্তর কলিকাতার একটি হালুইকরের দোকান হইতে নিয়মিতভাবে অনেকটাই অমৃতি প্রতিদিন অসিত। ডাঃ রায় ওই আসরে সদানন্দবাবুকে উপস্থিত থাকিতে বলিতেন। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে না হইলেও মাঝে মধ্যে সদানন্দবাবু উপস্থিত থাকার চেষ্টা করিতেন। ডাক্তার বিধান চন্দ্ররায় ব্রাহ্মধর্মালম্বী ছিলেন। এই ধর্ম্মাচরণ তাঁহার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া। পূর্ব কথায় আছে তাঁহার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হইলে তাঁহার পিতৃদেব অর্থাৎ ডাঃ রায়ের ঠাকুরদা কত্তৃক তিনি গৃহ হইতে বিতাড়িত হন।
একদিন রাত্রিবেলায় অমৃতি খাওয়ার আসরে সদানন্দবাবু উপস্থিত আছেন। মজলিসের আলোচনার বিষয় ছিল আধ্যাত্মিকতা। ডাঃ রায় সদানন্দের দিকে চাহিয়া একসময় বলিতে লাগিলেন, "ব্রাহ্মমতটি তথা কথিত হিন্দু ধর্ম্মাচরণ কারীদের কুসংস্কার আর গোঁড়ামীর থেকে অনেকটাই মুক্ত, সদানন্দ তুমি কি বল।
এইখানে বলা প্রয়োজন ডাঃ রায়কে সদানন্দবাবু 'স্যার' বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ডাক্তার রায়ের কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু এবং ডাঃ রায়ের মধ্যে যেরূপ কথোপকথন হইয়া থাকে। -
সদানন্দ: দেখুন স্যার, নিরাকারে বিশ্বাসী ব্রাহ্মমতটি নিঃসন্দেহে ভালো।আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের উদ্দ্যেশ্য যদি ভগবান প্রাপ্তি হয় তাহলে আধ্যাত্মিক সাধনার অন্তিমে সকলকেই নিরাকারে যেতে হবে। কিন্তু "অহং ব্রহ্মহস্মি" এই বাক্যে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার আপত্তি আছে অর্থাৎ এ কথায় মনে একরকম সংশয় জাগে।
ডাঃ রায়: তোমার সংশয়ের কারণ?
সদানন্দ: কারণ, প্রাথমিক ভাবে আমিই ব্রহ্ম, ইহা বলা বা ভাবার মধ্যে অহংগ্ভাব-আসে না কি?
ডাঃ রায়: হ্যা ঠিক, আসে বৈ কী।
সদানন্দ: অহং আবির্ভাবে নিজের কতৃত্ব প্রকাশ হয়ে পড়ে না কি?
ডাঃ রায়: হ্যা, তা পড়ে বৈকি।
সদানন্দ: তাহলে অহংকার ত্যাগ কোথায় হলো। কারণ শাস্ত্রে আছে- শাস্ত্র না মানলে মহাজন বাক্যে আছে অহংকার অবশ্যই বর্জনীয়, নচেত সাধন পথে ভগবান লাভ করা সুদূরপরাহত। অথচ উদ্দ্যেশ্য যদি ভগবান প্রাপ্তি, তবে প্রারম্ভে আমিই ব্রহ্ম এই উক্তি তো যুক্তি যুক্ত ঠেকছে না।
ডাঃ রায়: হ্যা, যুক্তি আছে বুঝলাম।
এই কথা বলিয়াই ডাঃ কহিলেন, "দেখ, আমারও গুরু আছেন। তবে তাঁর নাম জানতে চেয়ো না, আমি বলব না।"
ডাঃ রায়ের কথা শুনিয়া সদানন্দবাবু ভাবিতে লাগিলেন - এতক্ষণ আমি যাহা বলিলাম সব কিছুতেই ডাঃ রায়ের সায় পাওয়া গেল। অর্থাৎ সব কথাতেই হু, ঠিক, এই শব্দগুলি উচ্চারিত হইল। ডাঃ রায়ের মত রাশভারি ব্যাক্তিত্ব, যিনি অপরের কোন কথাতেই সহজে সায় দিতে চাহেন না। সেই তিনি কিনা আমার সব কথায় সম্মতি সূচক উক্তি করিয়া গেলেন। আমি তো যাহা কিছু বলিলাম সবই শ্রীশ্রী রামঠাকুরের পথ, মতের সমন্বয়েই বলার চেষ্টা করিয়া গিয়াছি। তাহা শুনিয়া তিনি এখন বলিতেছেন যে তাঁহারও গুরু আছেন। কিন্তু গুরুর নাম বলিবেন না বলিয়া দৃঢ়তা প্রকাশ করিলেন। ইত্যাদি ভাবনায় ভাবিত হইয়া কয়েক মুহুর্ত্ত পরে সদানন্দবাবু ডাক্তার রায়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, -"আচ্ছা স্যার, আপনার গুরু নাম না হয় নাই বললেন, আপনার গুরু নিশ্চয়ই আপনাকে কিছু উপদেশ দিয়াছেন ।এমন দুই, একটি উপদেশ বাণী বলতে আপনার আপত্তি আছে কী স্যার, তা শুনে আমাদেরও কাজে লাগতে পারে বৈকি।
ডাঃ রায়: আপত্তির কারণ দেখিনা। তা বলা যেতে পারে।
বলিয়া একটু সময় নিয়া বলিতে লাগিলেন,
-নিরহঙ্কারী হওয়া।
-কতৃত্ব বুদ্ধি ত্যাগ করা।
-ধৈর্য্য ধরা।
এর পরেই সদানন্দ ডাঃ রায়ের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, 'পরের শব্দটা কি স্যার সহ্য করা?’
কপট দৃষ্টিতে সদানন্দের দিকে চাহিয়া ডাঃ রায় কহিলেন, "ডেপো ছেলে কোথাকার।" বলিয়া চুপ করিয়া গেলেন। আর কিছুতেই বলিলেন না। এই খানেই সেদিনের অমৃতি মজলিশের ইতি ঘটিল।
উপরিউক্ত কাহিনী ব্যক্ত করিয়া শ্রদ্ধেয় সদানন্দদা কহিলেন, "এতে আমার অনুমান ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় সেদিন শ্রীশ্রী রামঠাকুরের উপদেশ বাণীর কথাই বলিয়াছিলেন। অবশ্য ইহা সম্পূর্ণ আমার অনুমান সাপেক্ষ।"

ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা: ২৬৯

শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৫



শ্রীশ্রী ঠাকুর যে বুজরুকদের সকল সময়ই এড়াইয়া চলিতে আমাদিগকে নির্দ্দেশ দিয়াছেন তাহা নিম্নলিখিত ঘটনা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে।
এক বত্সর আমাদের নোয়াখালী শহরে একজন যুবক সাধু গিয়াছিলেন। ঘটনাচক্রে আমাদের একজন শ্রদ্ধেয় গুরুভ্রাতার বাড়ীতে তিনি উঠিয়াছিলেন এবং তাঁহারা তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইলেন। ঐ সাধুটির ব্যাবহার আমাদের ঠাকুরের ব্যাবহারের সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিয়া আমরা অন্য যে কয়েকজন গুরুভ্রাতা তখন নোয়াখালী শহরে ছিলাম, সকলেই মনে মনে তাঁহার প্রতি বিরক্ত হইলাম এবং আমাদের যে গুরুভ্রাতাটি তাঁহার প্রতি খুবই আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, তাঁহার ঐ ভ্রান্তিতে আমরা একটু দুঃখিতও হইয়াছিলাম। শ্রীশ্রী ঠাকুরের সহিত কয়েকদিন পরই দেখা হইলে আমি ঐ সাধুকে তিনি চিনেন কিনা জিজ্ঞেস করিলে ঠাকুর তাঁহাকে চিনেন না বলিয়া বলিলেন। আমি বলিলাম যে, তিনি অনেকেরই গুরু কি নাম দিয়াছিলেন তাহা বলিয়া দিতেন এবং তাঁহার অপেক্ষা অনেক বেশী বয়সের ভ্দ্রলোকদেরও 'তুই' বলিয়া সম্বোধন করিতেন। আমার সমক্ষেই একজন সাব-জজ কে বলিলেন, 'তর তো শিব।' এই কথাগুলি শুনিয়া ঠাকুর বলিলেন, "এ ত ভাল না। এ ত বুজরুক। একজনের মনের কথা বলিয়া দেওয়া ত কিছুই নয়। একটু সামান্য প্রক্রিয়া করিলেই লোকের মনের কথা বলিয়া দিতে পারা যায়।" তিনি ঐ প্রক্রিয়ার কথা আমাকে তখন বলিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা সম্পূর্ণ মনে না থাকায় এবং অনাবশ্যক বোধে আমি আংশিকভাবেও তাহা প্রকাশ করিলাম না। বস্ত্ততঃপক্ষে ঐ সময়ে এবং পরেও ঐ সাধুর কথা ও আচরণ সম্বন্ধে আমি নিন্দনীয় অনেক কথা শুনিয়াছি এবং তাহার প্রভাবও নোয়াখালী হইতে একেবারেই লুপ্ত হইয়াছে।
শ্রীশ্রী ঠাকুর রামচন্দ্রদেব স্মরণে
শ্রী শুভময় দত্ত
পৃষ্ঠা: ১০১

শুক্রবার, ২৪ জুলাই, ২০১৫

সেই সময় প্রায় তিন বত্সর তিনি ঢাকা জিলার রাজবাড়ী থানার অন্তর্গত বেরপাড়া (বেহেরপাড়া) গ্রামের শ্রীসুধীর কুমার সারখেলের বাড়ীর ঠাকুর ঘরে বাস করিয়াছেন। ঐ বাড়ী হইতে প্রায় আধ মাইল দূর বাহেরক গ্রামে সত্যরঞ্জন গাঙ্গুলীর ও জ্ঞান আচার্য্য মহাশয়ের বাড়ী ছিল। উক্ত সত্যরঞ্জন গাঙ্গুলীর কাকা মনমোহন গাঙ্গুলী অতি দুশ্চরিত্র ছিল বলিয়া তাহাকে গ্রামবাসীগণ অত্যন্ত ঘৃণার পাত্র সাব্যস্ত করিয়া সমাজচ্যুত করিয়া রাখিয়াছিল। তাহার কার্য্যস্থল ঢাকা শহরে একটি বারবনিতার প্রেমে মুগ্ধ হইয়া সে তাহার বাড়ীতেই বহু বত্সর যাবৎ কালাতিপাত করিতেছিল, দেশের আত্মীয় স্বজন কাহারও সঙ্গে কোন সম্বন্ধ রাখিত না। প্রৌরাবস্থায় উপনীত হইলে সে ভিশন রক্তামাশায় রোগে আক্রান্ত হয়। তখন একেবারেই সহায় সম্বল বিহীন অবস্থা হওয়ায় কোথাও যাওয়ার তাহার শক্তি ছিল না। ক্রমে তাহার মরনোন্মুখ অবস্থা দেখিয়া ঐ মেয়েটি মনে মনে স্থির করিল যে, মনমোহন গাঙ্গুলীর বাড়ীর নিকটবর্ত্তী কোনও স্থানে তাহাকে রাখিয়া আসিলে নিশ্চয়ই কেহ না কেহ দয়ার্দ্র-চিত্তে তাহার শেষ সময়ের ক্রিয়া আদি সম্পন্ন করিবে। এই চিন্তা করিয়া সে অতি কষ্টে উক্ত মনমোহন গাঙ্গুলীকে তাহার বাড়ীর নিকটস্থ ভোমতাতা নামক কোন বৈষ্ণবের আখড়ার জঙ্গলের মধ্যে রাখিয়া যায়। ঐ আখড়াবাসীরা তাহাকে চিনিতে পারিয়া তাহাদের ঘরে আশ্রয় দেয়। ক্রমে গ্রামবাসীরা সকলেই এই সংবাদ পায়। কিন্তু তাহার জন্য সহানুভূতি হওয়া দুরে থাক বরং নাসিকা কুঞ্চন করিয়া অনেকেই, এমন কি তাহার ভ্রাতুষ্পুত্র সত্যরঞ্জনও, 'যেমন কর্ম্ম তেমন ফল', ইত্যাদি নানা কথা বলিয়া তাহার নিকটে গেলেও মহাপাপ হইবে মনে করিয়া দুরে সরিয়া থাকে। ঠাকুর, (তখন তাঁহাকে সকলে 'রামসাধু' ডাকিত) এই সংবাদ পাইয়া সত্যরঞ্জন বাবুকেও নানাভাবে বুঝাইয়া ঐ আখড়ায় নিয়া যান এবং উভয়ে মিলিয়া অতি কষ্টের সহিত সযত্নে সত্যরঞ্জন বাবুর বাড়ীতে একখানা ছোট ঘরে স্থান দেন। ঐ ঘরে থাকিয়া প্রায় তিন মাস কাল এই মৃত্যু শয্যায় শায়িত রক্তামশয়ের রোগীর দিবারাত্রি সর্ব্বপ্রকারের সেবা পরিচর্য্যা একাকীই সম্পন্ন করেন। তাহার দেহত্যাগ হইলে স্থানীয় একটি লোকও তাহাকে স্পর্স করিতে রাজী না হওয়ায়, ঠাকুর ও উক্ত সত্যরঞ্জন বাবু নিজ হাতে আম গাছ কাটিয়া যথা নিয়মে তাহার অন্ত্যষ্টি ক্রিয়া সমাপন করেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, যে সময়ে মনমোহন দেহত্যাগ করে ঠিক ঐ সময়ে তাহার অতি নিকটস্থ প্রতিবেশী নানা শাস্ত্রবিদ, অহরহ গীতা ও চন্ডীপাঠ এবং জ্যোতিষী হেমচন্দ্র আচার্য্যও দেহত্যাগ করেন। তাঁহার শ্মশানে বহু লোক সমবেত হইয়া খুব আড়ম্বরের সহিত অন্ত্যষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কিন্তু মনমোহনের শ্মশানে ঠাকুর ও সত্যবাবু ছাড়া আর কেহই যায় নাই।
উক্ত হেমচন্দ্র আচার্য্য মহাশয় ঠাকুরের একনিষ্ট ভক্ত জ্ঞান আচার্য্য মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। জ্ঞান দাদা জানিতেন যে, আত্মা দেহ ত্যাগ করিলে কি অবস্থায় আছে ইহা গোপনে জিজ্ঞাসা করিলে ঠাকুর তাঁহার ভক্তগনকে প্রকৃত অবস্থা জানাইয়া দিতে সক্ষম ছিলেন। জ্ঞান দাদা ঠাকুরকে একই সময় মৃত এই দুই ব্যাক্তির দেহত্যাগের পরের অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিলে ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, মনমোহনের আত্মা মুক্ত হইয়াছে, তাহার আর দেহ ধারণ করিতে হইবে না। কিন্তু হেম বাবুর আবার জন্ম হইবে।
উপরোক্ত ঘটনার কথা খুব সম্ভবতঃ আমি জ্ঞান দার মুখে এবং অন্য কাহারও মুখেও বহুবত্সর পূর্বেই শুনিয়াছি, কিন্তু তখন কিছুই লিপিবদ্ধ করার কি স্মরণ রাখার প্রয়োজন বোধ না করায় লোকের ও স্থানাদির নাম ভুলিয়া গিয়াছিলাম। এবার পাহাড়তলী কৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠার প্রায় প্রথম হইতেই নিত্যসেবাপরায়না শ্রীশ্রী ঠাকুরের অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী পরম শ্রদ্ধেয়া প্রিয়ভাষিনী দিদির সঙ্গে শ্রীশ্রী ঠাকুর প্রসঙ্গ আলোচনা কালে তাঁহার নিকট সকল কথা শুনিয়া তাঁহারই সমক্ষে এই বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করিলাম। তিনি ঐ ঘটনার সময় ঐ ঘটনার সময় ঐ সকল বাড়ীর অতি নিকটবর্তী তাঁহার পিত্রালয়ে থাকায় স্বয়ং সমস্ত প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন।
শ্রীশ্রী ঠাকুর রামচন্দ্রদেব স্মরণে
শ্রী শুভময় দত্ত
পৃষ্ঠা: ১২৯

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৫

 বেদবানী চতুর্থ খন্ড থেকে কিছু সত্য বাণী


"আপনি সন্ন্যাস ধর্ম নিবেন, যেখানে আকাশ, বায়ু, জল গাছ-পালাবৃক্ষাদি নাই সেখানে যদি যাইতে পারেন তবে নির্জনতা পাইবেন। সংসার ছাড়িয়া থাকিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। যেখানে গাছপালা, আগুন জল বায়ু [?] ছাড়িয়া এমন জায়গায় থাকিতে পারেন তবে সংসার ছাড়েন। নচেত কলিকাতা হইতে কাশী এক স্থান হইতে অন্য স্থানে গেলে সন্ন্যাস হয় না।"
বেদবানী:৪/১৪৯


"এই কৈবল্যনাথই নামের মূর্ত্তি জানিয়া অন্য কোন প্রলোভনের কর্ষণ হইতে মুক্ত হইয়া কৈবল্যনাথের পরিচর্য্যায়ই যত্নবান থাক।"
বেদবানী:৪/১৪৭


"কোন মূর্ত্তি নাই। নাম সত্য অবর্ন(ঈশ্বর) কল্পনা দ্বারা যাহা হয় তাহা সীমাবদ্ধ। নামের স্মরণ নিয়া থাকিলেই তাহা মূর্ত্তি প্রকাশ হইয়া পরে, যাহা দেখিয়া অর্থাৎ বোধ হইলে আর কিছু দেখে না বুঝিতে পারে না। নাম রূপ নাম মূর্ত্তি।"
বেদবানী:৪/ ১৫৫

"নাম করিতে জীবের কোন অঙ্গই দরকার হয় না। নাম স্বয়ং ভগবানই করিতে থাকেন। তাহার অধীন হইতে পারিলে নাম করা হয়। ঘুমের মধ্যেও এই নাম হয় একেই নাম সংকির্ত্তন বলে ও ভগবান বলিয়া থাকে মনটি শরীরের অধিন কাজেই নাম করার বাধকই মনকে জানিবেন। ঘুমাইলে মন কি দেহাদি কিছুই থাকে না তখন একমাত্র আত্মাই থাকে।"
বেদবানী:৪/১৬৫

"পূজা করিতে কি নাম করিতে দেহাদি মন বুদ্ধি লাগে না। কেবলমাত্র নামের অধীন হইয়া থাকাই পূজা হইয়া থাকে। মনের দ্বারা বুদ্ধির দ্বারা যে সকলের নানা উপাচারে পূজা করে তাহা ভাগ্যনুসারে ফল ভোগ করিয়া থাকে। কিন্তু নামকে পায় না। পূজা ও হয় না।"
বেদবানী:৪/৩২


"অবিদ্যার জন্যই লোকে অনিত্য বস্তুর জন্য অনুতাপ করিয়া সত্য যে অবিনাশী আত্মা তাহাকে ভুলিয়া অনিত্য যে জরা প্রকৃতি তার মোহে পড়িয়া কত্তৃত্বাভিমান যোগে কষ্ট পাইয়া থাকে। সত্যনারায়নই আত্মা জানিবেন।"
বেদবানী:৪/১৩৩


কোন ভক্তের পত্রের উত্তরে শ্রীশ্রী ঠাকুর লিখিয়াছিলেন "সর্ব্বশক্তিমান ভগবান সকলই সহ্য করিতে পারেন বলিয়া এবং কাহাকেও কোনরূপ উপেক্ষা করেন না, বিরক্তও হন না বলিয়া লোকে ভগবান বলে। তাঁহার ভক্তও তাঁহার কাছ হইতে শক্তি আহরণ এইভাবেই করে।" বেদবাণী ১/১০২

দৃষ্টান্ত

(1)উপরোক্ত বিষয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত শ্রীমান উপেন্দ্র কুমার সাহার নিকট হইতে দুইটী ঘটনা শুনিয়া আমি তাহা নিম্নে সংক্ষেপে বিবৃত করিতেছি।
একজন বৈষ্ণব শ্রীশ্রী ঠাকুরের নিকট চৌমুহনী আশ্রমে অনেক সময়েই যাইত এবং প্রত্যহই প্রত্যাবর্ত্তনকালে শ্রীশ্রী ঠাকুর নিকট হইতে নিত্যানন্দের ভোগের জন্য নানা প্রকারের ফলাদি পাইত।
সে লক্ষ্য করিতে লাগিল যে, ঠাকুরের নিকট কেহ কিছু প্রার্থী হইলে তিনি উপস্থিত কোন ভক্তকে তাহা দিয়া দিতে বলিতেন। ইহাতে তাহার লোভ আরও বাড়িয়া গেল। একদিন সে খুব দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিল যে, তাহার কয়েক বাঁধ ঢেউ(তোলা) টিন চুরে নিয়া যাওয়ায় সে খুবই বিপন্ন অবস্থায় পড়িয়াছে। এই কথা তাহার বলার কারণ তথাকার ঠাকুরের সেবকদের মধ্যে কয়েকজন খুব বড় টিনের ব্যাবসায়ী ছিল। তাহার বিশ্বাস ছিল যে, ঠাকুর ভক্তগনকে বলিয়া তাহাকে কয়েক বাঁধ টিন দিয়া দিবেন। ঐ বৈষ্ণবের সমস্ত কথা যে মিথ্যা তাহা ঠাকুর স্বয়ং জানা সত্ত্বেও, বৈষ্ণবের প্রার্থনা অনুযায়ী ভক্তদের তাহাকে কিছু টিন দিতে বলিলেন। ভক্তগণ বৈষ্ণবের সততা মনে মনে সন্দেহ করিয়া অবিলম্বে একটি লোককে তাহার বাড়িতে পাঠাইয়া জানিলেন যে, চুরির বৃত্তান্ত সর্ব্বৈব মিথ্যা। এই কথা ঠাকুরকে জানাইলে ঠাকুর তাহার প্রতি কোন ক্রোধ বা বিরক্তির ভাব প্রকাশ না করিয়া বলিলেন, "তাহার প্রয়োজনবোধ তো হইয়াছিল, সে জন্যই সে চাহিয়াছিল।"


(২) ঠাকুরের কোন ভক্ত নোয়াখালী হইতে পার্ব্বত্য ত্রিপুরার অন্তর্গত উদয়পুরে যাইয়া কোন সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তির নিকট শ্রীশ্রী ঠাকুরের দস্তখতি জাল এক পত্র দেখাইয়া বলিল যে তাহাকে তিনি তথায় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য পাঠাইয়াছেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের নাম ঐ ভদ্রলোকের জানা থাকায় তিনি ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করিয়া একখানা দালান প্রস্ত্তুত্ক্রমে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিলেন এবং তিনি সস্ত্রীক ঠাকুরের তথাকথিত ঐ ভক্তের নিকট হইতে নাম লইলেন। সেই ভদ্রলোকের যত্নে ভক্তটি সস্ত্রীক সে আশ্রমে থাকিয়া কিছুকাল পরমসুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল।
ক্রমে নানা কারণে ঐ ভদ্রলোকদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হইতে লাগিল। ভদ্রলোকটি চৌমুহনীতে শ্রীশ্রী ঠাকুরের নিকট আসিলেন এবং সেই ভক্ত সম্বন্ধে সমস্ত কথা লিখিয়া একখানা পত্র ঠাকুরকে দিলেন। ঠাকুর পত্রখানা পড়িয়া ভদ্রলোকটিকে নানা উপদেশ দিলেন। কিন্তু জালিয়াত ভক্ত সম্পর্কে কোন কথাই বলিলেন না।
ভদ্রলোকটির নিকট শ্রীশ্রী ঠাকুরের অপর সেবক নরেদ্র ভুঁইয়া সমস্ত কথা শুনিয়া ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন। কিন্তু ভদ্রলোকটি বলিলেন, "সে মিথ্যা কথা বলুক, আর যাহাই করুক, তাহারই দরুন আমি আজ পরম রত্ন লাভ করিলাম। সুতরাং রাগ করিবেন না। "
ভদ্রলোকটি চলিয়া যাওয়ার পর শ্রীশ্রী ঠাকুর শ্রীমান উপেন ও নরেন ভায়ার নিকট বলিলেন, "অনেকেই উপদেশ শুনিতে আসে কিন্তু কিছুই গ্রহণ করেন না। এই ভদ্রলোকটি কিছু গ্রহণ করিয়াছেন।"


শ্রীশ্রী ঠাকুর রামচন্দ্রদেব প্রসঙ্গ ও অমৃতবাণী
শ্রী শুভময় দত্ত
পৃষ্ঠা:৩১
একবার এক অশিতি-প্রায় বৃদ্ধা একটি বাস্তব ঘটনার কথা বলেছেন। একদিন উত্তর পাড়ার মেথর পল্লীতে হঠাত আগুন লেগে যায়। মুহুর্তের মধ্যে আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। দরিদ্র মেথরদের ঘরগুলি পুড়ে ভষ্মীভূত হয়ে যাচ্ছে অথচ অস্পৃশ্য বলে কেউই আগুন নেভাতে যাচ্ছে না। ঠাকুর এই করুন দৃশ্য দেখে ও আর্তনাদ শুনে তৎ ক্ষনাৎ গঙ্গা থেকে কলসী ভরে জল এনে আগুন নেভানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঠাকুরের এই দৃশ্য দেখে,জাত্যাভিমান ভুলে সকলেই ঠাকুরের সাথে আগুন নেভানোর কাজে নেমে পড়লেন। সকলেই অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলো যে আগুন দমকলের সাহায্যে নেভানো দুঃসাধ্য তা ঠাকুরের হাতে ছিটিয়ে দেওয়া শান্তি বারিতেই শান্ত হয়ে গেল। যেখানেই ঠাকুর জল সিঞ্চন করেন, সেখানেই আগুন শান্ত হয়ে নিভে যায়। সেদিন থেকে ঠাকুরের নাম হল "দয়াল ঠাকুর" বা "দয়াময় ঠাকুর।" ঐ আগুন নেভানোর সময় ঠাকুর পিচ্ছিল রাস্তায় পড়ে গিয়ে হাটুতে ব্যথা পান। সেই ব্যথা দীর্ঘদিন ঠাকুরের হাটুতে প্রকট ছিল।

ছবিতে রামঠাকুর(দ্বিতীয় খন্ড)
মহানন্দ দাশ
পৃষ্ঠা: ১৭

বুধবার, ২২ জুলাই, ২০১৫

একবার সাউথ সুবার্বান স্কুলের শিক্ষক শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার মজুমদার মহাশয় সৌভাগ্যক্রমে শ্রীশ্রী ঠাকুর মহাশয়ের পুরী গমনের সঙ্গী হইয়াছিলেন। ঠাকুরের সহিত পুরীধামে থাকা কালে একদিন অক্ষয়বাবুর আকাঙ্খা হয়, তিনি শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের সন্ধ্যারতি দর্শন করিবেন। অক্ষয়বাবু তাঁহার বাসনার কথা ঠাকুর মহাশয়ের কাছে নিবেদন করিলে ঠাকুর মহাশয় সম্মত হইয়া তাঁহাকে লইয়া সন্ধ্যার পূর্বে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের মন্দির দ্বারে পৌঁছিলেন। শ্রীমন্দিরের প্রধান ফটক সিংহদ্বার, যেখানে শ্রীঅরুণস্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত আছেন সেইখানে ঠাকুর মহাশয় দাঁড়াইয়া অক্ষয়বাবুকে আরতি দর্শন করিতে শ্রীমন্দিরে পাঠাইয়া দিলেন। তখন সন্ধ্যারতি আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। কাঁসর ঘন্টা এবং নানাবিধ বাদ্য যন্ত্রের সগম্ভীর ধ্বনিতে মন্দির প্রাঙ্গনে গমগম করিতেছে। সুগন্ধি ধূপ, কর্পুর, চন্দন, অগুরু, ইত্যাদির সুগন্ধে চারিদিক আমোদিত। অক্ষয়বাবু আরতি দর্শন করিতে শ্রীমন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। জগন্নাথ দেবের সন্ধ্যারতি তখন নানা উপাচারে প্রায় দুই তিন ঘন্টাব্যাপী চলিত। অক্ষয়বাবু শ্রীবিগ্রহ দর্শন ও প্রনাম করিয়া কিছুক্ষণ আরতি দর্শন করার পর, ঠাকুর মহাশয় মন্দির দ্বারে একাকী আছেন বিবেচনা করিয়া সিংহদ্বার অভিমুখে ফিরিয়া আসিলেন। অরুণ স্তম্ভের নিকট আসিয়া অক্ষয়বাবু দেখিতে পাইলেন, ঠাকুর মহাশয় স্থিরভাবে স্তম্ভমূলে দন্ডায়মান।
দীন মলিন বেশের এক বৃদ্ধা রমনী একটি থালায় ছোট ছোট কতগুলি প্রদীপ দ্বারা শ্রীশ্রী ঠাকুরকে আরতি করিতেছেন। শ্রীমন্দির অভ্যন্তর হইতে সন্ধ্যারতির শঙ্খ, ঘন্টার ধ্বনি ভাসিয়া আসিতেছে। সিংহদ্বার প্রান্তে অরুণ স্তম্ভের পাদদেশে একজন বৃদ্ধা প্রজ্বলিত প্রদীপে সজ্জিত থালাখানা দুই হস্তে দোলাইয়া নানা ভঙ্গিতে, নানা মুদ্রায়, তন্ময় অবস্থায় দন্ডায়মান শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে আরতি করিয়া চলিয়াছেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর পলকহীন শূন্য দৃষ্টিতে প্রস্তর মুর্ত্তিবত ধীর, স্থির ভাবে দন্ডায়মান। তিনি যেন ধ্যানস্থ এক বিগ্রহমুর্ত্তি। যতক্ষণ শ্রীমন্দিরে আরতি চলিতেছিল ততক্ষণ পর্য্যন্ত বৃদ্ধা সেই একই বস্তু প্রদীপ্ত দীপের থালা দোলাইয়া আরতি করিয়া গেলেন শ্রীশ্রী ঠাকুরকে। অক্ষয়বাবু একটু তফাতে থাকিয়া ওই আরতি দৃশ্য দর্শন করিতেছিলেন। তিনি নিকটে গেলেন না পাছে তাঁহার উপস্থিতিতে কোন ব্যাঘাত ঘটে।
বহু সময় ব্যাপী আরতি হইল। কিন্তু ছোট ছোট প্রদীপের শিখা সমানভাবে প্রদীপ্ত ছিল। একটি দীপও নির্ব্বাপিত হইবার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ইহাও আশ্চর্য্য ঠেকিয়াছে অক্ষয়বাবুর।
যথা সময়ে শ্রীমন্দিরের সন্ধ্যা আরতি শেষ হইল। মলিন বেশধারিনী অজ্ঞাত সেই বৃদ্ধা রমনীও তাহার আরতি সমাপন করিয়া শ্রীশ্রী ঠাকুরকে প্রনাম করিয়া ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন। অক্ষয়বাবু বৃদ্ধাকে আর দেখিতে পাইলেন না। তিনি ঠাকুর মহাশয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলে দেখিলেন তিনি স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। কৌতূহলবশে অক্ষয়বাবু ঠাকুর মহাশয়কে বৃদ্ধার আরতি করার কথা জিজ্ঞাসা করিলে ঠাকুর বলিলেন যে ভিড়ের মধ্যে হয়তো কেহ মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে না পারিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া শ্রীজগন্নাথ দেবকে আরতি করিয়াছেন। তাঁহাকে কেহ আরতি করেন নাই। অক্ষয় বাবু ঠাকুরের এই বাক্য মানিতে পারিলেন না। কারণ তিনি সমস্ত ঘটনা স্বচক্ষে স্পষ্টভাবে নিরীক্ষণ করিয়াছেন। ভুল হইবার কোন কারণ নাই। কিন্তু ঠাকুর মহাশয় ওই বিষয়ে কোনরূপ গুরুত্ব না দিয়া সম্পূর্ণ নির্ব্বাক থাকিয়া গৃহাভিমুখে রওনা হইলেন। অক্ষয়বাবু ঠাকুর মহাশয়কে অনুসরণ করিলেন।

ছন্নাবতার শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রী সদানন্দ চক্রবর্ত্তী
পৃষ্ঠা: ২৮৭

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০১৫




ঠাকুরের পরীক্ষা

ঠাকুরের সর্বধর্ম সমন্বয়ে হিন্দু, মুসলমান,বৌদ্ধ, ঈশাই কোনো ধর্মের প্রতিই তাঁর অনীহা ছিল না, ছিল না কোনো বিদ্বেষ। কিন্তু ভিন্ন ধর্মালম্বীরা ঠাকুরের কাছে নাম নিতে এমনি এমনি ছুটে আসেনি। তারা ঠাকুরকে নিয়ে হাসাহাসি করতো কারণ ঠাকুরের ছিল না গেরুয়া বসন, ছিল না লোক দেখানো সাধন ভজন, ছিল না ভরং, ছিল না জনসমক্ষে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সামান্যতম প্রচেষ্টা। কেউ অবজ্ঞা করলে তিনি সেসব লোকের থেকে শতযোজন দুরে চলে গেছেন। মুহুর্তে আবার শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে ঠাকুরের আরাধনা, পূজা য়ারা করেছেন, ছুটে গেছেন তাদের কাছে। গুরু প্রসঙ্গ, আলোচনায় শ্রী হীরালাল সাহা বললেন- বাংলাদেশের দক্ষিনি মুসলমানরা হিন্দুদের 'মালায়ুম' বলে ডাকতো। শ্রীশ্রী রামঠাকুরের নাম কোনো আশ্রিত হিন্দু বললেই তারা তাচ্ছিল্য ভরেই বলতো- মালায়ুমরা তরার ঠাকুরকে পরীক্ষা করুম কত বড় ঠাকুর তাইন।
ঠিক আছে কইরা দেখ। তরার পরীক্ষার কথা ঠাকুর আগেই জানব। যাইতে ঠাকুরের পূজার জন্য কিছু একটা লইয়া যাইস বললেন চৌমুহনীর হীরালাল সাহা। একদিন চার মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত মানুষ চৌমুহনীর নরেন্দ্র ভুইঁয়ার টালির ঘরে ঠাকুরের পরীক্ষার জন্য উপস্থিত। ঘরে বহু আশ্রিত, নাম প্রার্থী ও ভক্তরা ঠাকুরের পাদস্পর্শে ধন্য হবার জন্য অপেক্ষারত। চার মুসলমানও সেই ভক্তদের মাঝে গিয়ে বসলেন। তাদের হাতে হাড়িতে করে নিয়ে আসা ভোজ্য নিবেদন করতে লাগলেন। শ্বেত পুষ্পবত পাদপদ্মে স্পর্শ করে প্রনাম করতেই ঠাকুর আশীর্বাদ শেষে বললেন- সবাইকে প্রসাদ দিয়া যান। সব্বার ক্ষেত্রে ঠাকুরের একই নির্দেশ। দর্শন ও স্পর্শেই ঠাকুরের ভোগ গ্রহণ। তাই প্রসাদ বিতরণের নির্দেশ। বারোটা বাজার কাছাকাছি। এতক্ষণে সমস্ত আশ্রিত ও শ্রদ্ধালুরা - গুরু প্রনাম জানিয়ে চলে গেছেন। চার মুসলমান পরীক্ষক তখনও ঠায় বসে। তাদের মনে শংকা। শ্রীশ্রী ঠাকুর তাদের দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে বললেন - ঠাকুরেরে ভোগ নিবেদন কইরা প্রসাদ লন। দেরী কইরেন না। ভোগের সময় বইয়া যায়।
ঠাকুরের আহ্বান শুনেও মুসলমান চারজন নিশ্চুপ। শুধু গুরুর মুখপানে তাকিয়ে আছেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর খুব কম কথা বলতেন তা সব্বারই জানা। তবু দিব্যদৃষ্টির প্রভাবে চার মুসলমানের মনের কথা জেনে আবার আহ্বান জানালেন- যা গুরুর নামে আনছেন তাই দেন। লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই।
এ যেন গুরুর তীক্ষ্ণ নির্দেশ। তারা চারজন তাদের হাতের পাত্রের মুখ খোলে তার ভিতরে হাত দিলেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বেশ বড় আকৃতির অনেক অনেক বাতাসা। সব্বার হাঁড়ি থেকে যেন অফুরন্ত বাতাসা বেরুচ্ছে। বিস্ময়ে হতবাক চার মুসলিম যুবক। কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে ঠাকুরের পায়ে ধরে কাদতে শুরু করলো। বলতে লাগলো ঠাকুর আমাদের অপরাধ মাপ কইরা দেন। আমরা না বুইঝা এত বড় পাপ করছি। আপনারে পরীক্ষা করতে আইছি। আমাদের পাপের সীমা নাই। আপনি আমরারে বাঁচান। ছি ছি আমরা নরাধম। আপনারে সন্দেহ করছি। .....বিলাপ আর কান্না তাদের আর থামে না। তাদের অশ্রু শ্রীশ্রী ঠাকুরের পাদপদ্মে বিগলিত ধারায় বইতে থাকে। ঠাকুর একে একে চারজনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন- জয় সত্যনারায়ণ, জয় সত্যনারায়ণ, সত্যের জয় সর্বত্র। সত্যরে ধৈরা পইরা থাকেন।
তারা কাতর কন্ঠে বললেন- ঠাকুর আমাদের নাম দেন। ঠাকুর আশীর্ব্বাদ ও বরাভয়ের ভঙ্গিতে- চারজনকেই নাম দিলেন। বললেন- নাম লইয়া স্বধর্মে পইরা থাকেন। ইসলাম ত্যাগ কইরেন না। নাম করলেই হয়। সর্বদা ধীর হইতে হয়। ধীরে অভ্যাসেই সংসার ত্রান পায় নামের অভ্যাস যোগে থাকিতে থাকিতে মনের গ্লানি দূর হইয়া দেহমন, চিত্ত, ভাব সকল পবিত্রতা লাভ করিয়া পরম শান্তি পাওয়া যায়। নামই চিন্তামনি। নামে বিশ্বাস রাইখেন।
ঠাকুরের চরণে মাথা রেখে চারজনই বললেন- ঠাকুর আমাদের মনের গ্লানি, অপরাধবোধ কীরূপে দূর হবে?
ঠাকুর পরমস্নেহে বললেন- জগতে কাহারো দোষ দেখিতে হয় না। সরলতা সহ নাম করিয়া যান। সরলতাই আনন্দ উত্পন্ন করিয়া লয়।
কী করেছিল ওই চার মুসলমান ঠাকুর পরীক্ষক? তারা গুরুকে পরীক্ষার জন্য হাঁড়িতে নিষিদ্ধ মাংস নিয়ে এসেছিল। কিন্তু গুরু কৃপায় তা বাতাসাতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। তাই ধন্য হয়ে চার উদ্ধত মুসলিম হয়ে যায় শ্রীশ্রী ঠাকুর অন্তপ্রাণ। সবই শ্রীগুরুর অপার মহিমা। অশীতিপর বৃদ্ধ হীরালাল সাহা ঠাকুরের ওই সব কথা বলতে বলতে আরও বললেন- আমার পরম সৌভাগ্য ঠাকুর দেহ রাখার পর সে পবিত্র দেহ স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ঠাকুর দক্ষিন বাজারের গৃহে রবিবারের দুপুর দেড়টায় দেহ রাখেন আর আমি দৌড়াইয়া গিয়া দেখি সব শেষ। আমার বুক ফাইট্টা যাইতে ছিল। তবু ঠাকুরের পটে তিনি আছেন ভাইবা মনে সান্ত্বনা পাইছি।
আচ্ছা চার মুসলমানের শিষ্যত্ব গ্রহনের ও গুরুরে পরীক্ষায় যে কথা কইলেন তাকি আপনে দেখছেন?
কী কইরা দেখুম? ঠাকুরতো সব্বাইরে বাইর কইরা দিয়া তার পরে তান বিভূতি দেখাইছেন। আমরা সব শুনছি ওই মুসলমান ভক্তদের কাছ থেইক্কা। তারা বাইচ্চা থাকা অবধি সত্যনারায়ণ দিত আর ঠাকুরের জন্মদিন ও বহু পূজা পার্বন ঠাকুরের নির্দেশে করত।

পরমেষ্ঠী গুরু শ্রীশ্রী রামঠাকুর
ডঃ প্রশান্ত কুমার ভট্টাচার্য
পৃষ্ঠা: ৪৮২

রবিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৫

এক কায়স্থের কন্যার বিয়ে হচ্ছে না শুনে শ্রীঠাকুর এক ব্রাহ্মণের ছেলের মাকেই বলে বসলেন, "মা আপনার ছেলের জন্য ঐ মেয়েটিকে ঘরে আনেন না কেন?"
-"বাবা, আমরা যে ব্রাহ্মন।"
-"ও তাতো আমি জানতাম না। আমি তো ব্রাহ্মন খুইঁজা পাই না।"
(চতুর্থ মোহান্ত মহারাজের ডায়েরি হতে উদ্ধৃত।)

শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৫

শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০১৫

"কখন পশিলে হৃদয়ে আমার" (প্রথম মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ হরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত।) কখন পশিলে হৃদয়ে আমার জানিতে আমারে দাও নি; গোপনে আমায় ভাল যে বেসেছ বুঝিতে আমি তা পারি নি হৃদয়ের মাঝে আসন তোমার, পাতা আছে তা দেখি নি। বিনা আহ্বানে বসেছ সেখানে ডাকিতে আমার হয় নি। তুমি যে আমার এত কাছে থাক হৃদয়নিভৃতমন্দিরে, ঘুম-ঘোর মোর কেটে গেল আজি তোমার চরণ মঞ্জিরে; হৃদয়ের রাজা হৃদয়-আসনে বসে আছ দিবা যামিনী, পরশে তোমার হৃদি শতদল শিহরে উঠিল অমনি। আর নহি একা হৃদয়ের সখা হৃদয়-কমলে বসিয়ে; দেখে মোর ব্যথা পাও মন-ব্যথা, ব্যথা দিতে আস মুছায়ে, দাও প্রভু, দাও শকতি আমায়, তোমার চরণে প্রণমি। তোমার চরণ পরশে এ প্রাণ ধন্য হইবে এখনি।

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫

This video is dedicated to all Guru-Brothers and Sisters throughout the globe. Love and Light! Jai Ram! ♥♥

Mere Gurudev - Krishna Das

1. Mere Gurudev, charanon par sumana shraddha ke arpita hai
Tere hee dena hai jo hai. Wahi tujha ko samarapita hai

My Gurudev I offer these flowers of my faith at your feet
Whatever I have, you have given to me, and I dedicate it all to you.

2. Na priti hai pratiti hai, na hi puja ki shakti hai
Meraa yaha man, meraa yaha tan, meraa kan kan samarapita hai

I have no love, nor do I know you.
I don’t even have the strength to worship you,
But this mind of mine, this body of mine,
my every atom is dedicated to you.

3.Tuma hee ho bhaava men mere, vicharon mein, pukaron mein.
Banaale yantra ab mujhko mere saravatra samarapita hai

You are the only one in my heart and my thoughts.
You are the one who I call out to.
Now Make me your instrument...all I am I offer to you.

মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০১৫

Indu Babu's son- Lost and found.

Indu Babu had just taken on rent a house in Bidden Street, Kolkata. His wife and children had arrived a day earlier from Dhaka. Next evening, his housemaid went out to get kerosene and groceries from nearby Cornwallis street. Unknown to anyone Indu babu's five year old son Poltu followed her. The maid did not know that either. She returned but there was no sign of Poltu.
An hour went by and panic set in the house. Indu babu rushed to Prabhat babu's house in a taxi but he was not there. A relative of Prabhat babu worked in the Jorasako police station. In order not to lose time, Indu Babu took Prabhat Babu's nephew with him to the police station. Madan Babu, the station in charge, understood what had happened and called all the police stations in Kolkata. But, as luck would have it, none of the kids found matched Poltu's description. They even checked the hospitals, but to no avail.
So they decided to return home only to find Prabhat Babu waiting for them in the living room. On hearing about what had happened he went to meet Thakur, who was also in Kolkata at that time. Thakur advised that the news should be flashed and that the lost child will return.
It was already 11 pm but Prabhat Babu knew that there was an advertisement agent living nearby. The got hold of him and put an insertion in two dailies - Amrita Bazaar Patrika and Dainik Basumati. Both Indu Babu and Prabhat Babu spent the night awake, without eating, in the living room. In the morning Prabhat Babu left for a couple of hours for some urgent work and Indu Babu decided to visit a well known astrologer. He heard Indu Babu, closed his eyes for sometime, and said that Poltu should be home by the time he returns or would be coming very soon.
Indu Babu rushed home to find that Poltu was indeed back. A gentleman who had found Poltu had taken him to the Mochee Pada police station. He had read the advertisement and came to Indu Babu's house, took his brother-in-law to the police station and brought him back. The gold ring which the child was wearing was also collected from the police station where it had been deposited for safety.
There was relief at home. Thakur's advice had come true. Whatever had to happen had happened. This tension and suffering was predestined. As luck would have it Madan Babu had called all the police stations except Mochee Pada. In fact, while returning home after putting in the advertisement, even the agent had suggested that they go to Mochee Pada police station and Indu Babu had turned down the suggestion! But the best was yet to come.
Indu Babu's wife was very happy. First she fed Poltu, calmed him down and then went about asking, the little kid of five how he had crossed such big roads without getting into trouble?
Poltu said, "I was not worried at all. Why should I have been? Thakur was holding my fingers when I was crossing the roads! It was only when a crowd had gathered around me that Thakur left me and I was lost."
"Shri Ram Thakur Premanjali"
By Sri Sunit Banerji
রামঠাকুর ছোটদের খুব ভালবাসতেন। ভক্তের বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা থাকলে তিনি তাদের সাথে খুব মজা করতেন। আর ছোটরাও তাঁর কাছে নানান আবদার করতেন। এমনি অনেক ঘটনার দু-একটা ঘটনা শুনাচ্ছি..."একান্নবর্ত্তি পরিবার, ছোট ছোট ভাইবোন সবাই একসাথে থাকি। সেই সময় ঠাকুর আমাদের বাড়িতে মাসখানেক ছিলেন। ঠাকুরকে আমরা আমাদের প্রিয়জন বলেই মনে করতাম। স্নানের পর আমরা নিজেদের গায়ে পাউডার দিতাম- কিন্তু ঠাকুরকে গায়ে পাউডার দেওয়ার কথা কেউ বলে না। আমরা ভাইবোনেরা ঠিক করলাম ঠাকুরের গায়ে পাউডার মাখিয়ে দেবো। আমাদের আবদার ঠাকুরের কাছে নিবেদন করলাম। আবদার সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্জুর। আমরা পরমানন্দে ঠাকুরকে পাউডার মাখিয়ে পরিপাটি করে সাজিয়ে দিলাম। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। আমাদের আনন্দ দেখে ঠাকুর ও খুব খুশি হলেন।...(স্মৃতির দর্পনে, প্রকাশ "শবরী", লেখিকা জ্যোত্সনা জোয়ারদার।)
...ঠাকুর মশাই তখন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) চাঁদপুরে এক পরিচিত ভক্ত বাড়িতে ছিলেন। ..."ঠাকুর আছেন, তাই উত্সবও চলছে আর ভক্তদের অবিরাম আনাগোনাও চলছে। এহেন সুন্দর পরিবেশেও মুশকিলে পড়তে হলো বাড়ির ছোট ছেলেটিকে। কারণ সে স্নান করে এসেছে ঠিকই। কিন্তু ভেজা প্যান্টটি পাল্টে শুকনো প্যান্টটি পরার মত একটু নিরিবিলি জায়গা কোথাও পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি পর ঠাকুরের ভেজান দরজা একটু ফাঁক করে দেখতে পেল বুকের উপর একখানা খবরের কাগজ রেখে ঠাকুর মশাই চোখ বুজে শুয়ে আছেন। চুপি চুপি ঠাকুরমশায়ের ঘরে ঢুকে যেই ভেজা প্যান্টটি ছেড়ে শুকনো প্যান্টটি পরার উপক্রম করলো অমনি ঠাকুর মশাই বিছানার উপর উঠে বসে হাততালি দিয়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে বললেন, "দেইখ্যা ফালাইছি, দেইখ্যা ফালাইছি।'' আর যায় কোথায়? শিশুটির পাল্টা জবাব, অসভ্য অসভ্য কোথাকার। চুপচাপ ঘুমিয়েছিল, আর আমাকে প্যান্ট পাল্টাতে দেখে অমনি উঠে বসেছে। একেবারে অসভ্য। শিশুটির বাবা-মা ছুটে এল। তাকে এই মারে তো সেই মারে। ঠাকুর মশাই একটু চুপ করে থেকে বললেন, "আপনারা আবার এর মধ্যে আইলেন ক্যান? আমি তো ওর লগে একটু মজা করত্যাছিলাম।" এই হলো আমাদের গুরু শ্রীশ্রী রামঠাকুর।"...("কিছু কথা" প্রকাশ "শবরী" ১৪১২ সন, লেখিকা শ্রীমতী রঞ্জু সাহা।)
ডক্টর গোপীনাথ কবিরাজ মশাইয়ের উক্তি, "তিনি সর্ব্বভুতে সত্যই ভগবৎ দর্শন করিতেন -" এমনি বহু ঘটনার একটি হল, রামঠাকুর তখন কলকাতায়, এক ভক্তের বাড়িতে আছেন। দলে দলে দর্শনার্থী আসছেন তাঁকে প্রনাম করতে। খবর পেয়ে কয়েক জন মহিলা আসেন রামঠাকুরকে প্রনাম করতে। গৃহস্বামী তো সেই মহিলাদের কিছুতেই ঠাকুরের কাছে যেতে দেবেন না, তাঁদের অপরাধ তাঁরা সামাজিক দৃষ্টিতে পতিতা। রামঠাকুর তো পতিত পাবন, ঐ মহিলাদের কথা তাঁর কানে যেতেই বলেন, -"আমি অন্ধ, আমি তো চোখে দেখিনা - ছোট বড়, পতিত অপতিত, সাধু অসাধু কিছুই দেখিনা। তারা যখন আসতে চায় তখন আসিতে দিতে আপত্তি কি?" - ঠাকুরের এই কথায়, গৃহস্বামী ঐ মহিলাদের ঠাকুরের কাছে নিয়ে আসেন ও দূর থেকে নমস্কার করতে বলেন, মহিলারা রামঠাকুরের শ্রীচরণে নিবেদন করার জন্য কিছু ফুল এনেছিলেন, দূর থেকেই তাঁরা ঐ ফুল ছুড়ে দিতে আরম্ভ করলেন, পরম দয়াল রামঠাকুর ঐ ফুল তুলে মহিলাদের মাথায় দিলেন, মাথায় হাত দিয়ে আশীর্ব্বাদ করলেন। আর ঐ মহিলারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই ঘটনায় ভক্তেরা এক নূতন শিক্ষা লাভ করলেন।

সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০১৫



'শ্রীশ্রী রামঠাকুরের কথা', মহেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী পৃষ্ঠা ৪০/৪১ থেকে রামঠাকুরের আধ্যাত্মিক শক্তি সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। 'তাঁহার শান্তিপুরস্থিত নিজ বাড়িতে ঠাকুর কতদিন বাস করিয়াছিলেন। তত্কালীন ঠাকুরের দুই-একটি বিভূতির পরিচয় তিনি নিজেই পাইয়াছেন। তাঁহার বাড়িতে জ্যেঠা গোপীনাথ নামে এক বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। ঠাকুর গোপীনাথের সেবা পুজাদি করিতেন। তাঁহার সেবা-পূজায় পাষান দেবতা গোপীনাথ জাগ্রত দেবতায় পরিনত হইয়াছিলেন। ঠাকুর মন্দির দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিতেন। বাহির হইতে শুনা যাইত মন্দিরের অভ্যন্তরে মধুর নূপুর ধ্বনি হইতেছে, কে যেন নৃত্য করিতেছে।
গোপীনাথের সান্ধ্যভোগের বরাদ্দ ছিল এক জোড়া সন্দেশ। একদিন ঠাকুর শান্তিপুরের অনেককেই আমন্ত্রণ করিলেন গোপীনাথের প্রসাদ গ্রহনের জন্য। মুখোপাধ্যায় মহাশয় ইহার কোনো খবরই জানিতেন না। সন্ধ্যার পর লোক প্রসাদ পাওয়ার নিমিত্ত উপস্থিত হইলে তিনি অপ্রতিভ হইলেন। কিন্তু ঠাকুর বলিলেন, তাঁহার উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নাই। উপস্থিত মত যাহা হয় বিধি ব্যাবস্থা করা যাইবে। আশ্চর্যের বিষয়, গোপীনাথের অফুরন্ত ভান্ডার - উপস্থিত প্রত্যেকেই গোপীনাথের প্রসাদ এক জোড়া করিয়া সন্দেশ পাইলেন। কিন্তু এক জোড়া সন্দেশ তখনও তাঁহার পাত্রেই রহিয়া গেল। সকলে ইহাতে চমত্কৃত হইল। দামোদর মুখোপাধ্যায় মহাশয় বলিয়াছেন ঠাকুর তত্কালে সুক্ষ্মদেহে বিচরণ করিতেন। একই সময়ে কলিকাতা ও সিমলায় ঠাকুরকে দেখা গিয়াছে।'
একদিন শ্রীবাস অঙ্গনে উত্সবের আয়োজন হয়। ভক্তেরা প্রত্যুষে কির্তন আরম্ভ কইরা রাত্র ১২ টায় কির্তন সমাপন করেন। সেদিন মহাপ্রভু কীর্তনে কখনও হাসি, কখনও কান্না, কখনও উদ্দাম নৃত্যে এতই বিভোর ছিলেন যে ভক্তেরা প্রভুরে প্রসাদ গ্রহণ করতে বলার সুযোগ ও সাহস পান নাই। কির্তনান্তে মহাপ্রভু সুস্থ হইয়া গদাধররে কইলেন - গদাধর আজ তোমরা আমারে মহাপ্রসাদ দেও নাই। আমি ক্ষুধার্ত। আমারে প্রসাদ দেও।
এই কথা শুইনা শ্রীবাস, গদাধরাদি ভক্ত অন্দরমহলে গিয়া দেখেন কিছুমাত্র প্রসাদ নাই। তাঁরা ম্লান বদনে অবনত শিরে মহাপ্রভুর সামনে দন্ডায়মান থাকায় প্রভু জিজ্ঞাসা করলেন - কী হইল, আমারে প্রসাদ দিলা না?
গদাধর সাশ্রুনেত্রে নিবেদন করিল - প্রভু, প্রসাদ বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নাই।
তা শুইনা প্রভু উক্তি করলেন - প্রসাদের শেষ নাই। প্রসাদ কখনও শেষ হয় না। তোমরা যাও। গিয়া যেই যেই পাত্রে যেই যেই জিনিস ছিল সেই সকল পাত্র পরিষ্কার কইরা অন্য একটা পাত্রে সমস্ত জিনিস একত্র কইরা প্রসাদ তৈয়ার কর।
প্রভুর আদেশে ভক্তেরা পুনরায় অন্দরে গিয়া সব পাত্র পরিষ্কার কইরা ঘৃত, দধি, মধু, খই, বাদাম, কিশমিশ, মোনাক্কা, জায়ফল ইত্যাদি সংগ্রহ কইরা আনন্দ ভরে আইসা মহাপ্রভুর সামনে পাত্রটি রাখলেন।
প্রভু দেইখা কইলেন - একী? এইখানে রাখছ কেন? সব জিনিস একসঙ্গে মিলাইয়া প্রসাদ তৈয়ার কইরা সকলেরে দেও, আমারেও দেও।
গদাধর প্রসাদ তৈয়ার কইরা সকলেরে দিল, আমারেও যথেষ্ট পরিমানে প্রসাদ দিল। আমি অতীব ক্ষুধার্ত ছিলাম বইলা পরম তৃপ্তি সহকারে পেট ভইরা প্রসাদ পাইলাম। সেদিন থাকা এই প্রসাদের নাম হইল মালসা ভোগ।
এই বলিয়া ঠাকুর কিছু সময় নীরব থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিয়া উঠিলেন - আমিই গৌরাঙ্গ দেব। ঠাকুর তখন সম্পূর্ণ ধ্যানস্থ অবস্থায় অর্ধনিমীলিত চক্ষে বসে আছেন। আশ্রিতরা হাতজোড় করে বসে আছেন।
ঠাকুরের ধ্যানস্থ অবস্থা ভঙ্গ হইলে তিনি বললেন - আপনেরা এখানে বইসা আছেন কেন?
ডাক্তার জে.এম দাসগুপ্ত উত্তরে জানালেন - বাবা আমরা আপনার কথা শুনবার জন্যই বসে আছি।
শ্রীশ্রী ঠাকুর হাসিমুখে বললেন -ভালো, আমার কথা শুইনা করিমউল্লা, সোনাউল্লা হন। বকাউল্লা হইবেন না।
একবার ঠাকুর চলেছেন পায়ে হেঁটে বরিশালের এক পল্লী গ্রামের পথে। সঙ্গে আছেন বহু ভক্ত যেমন সুধীর চক্রবর্তী, আছেন ধীরেনবাবু, মনমোহন বাবুরা। ঠাকুর হেঁটে চলেছেন দ্রুত চলার ছন্দে মরাল গতি। যেন রাজহংস গলা উঠিয়ে চলেছে জল ভেদ করে। মসৃন ঢেউ প্রান্তরের আগেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সুধীর চক্রবর্তীরা কুল পাচ্ছে না ঠাকুরের সাথে হেঁটে। দূর থেকে ঠাকুরকে দৃষ্টি গোচরে রাখছে। ঠিক এমনি একটি সময় গায়ের একটি কচি বধু সিক্ত নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুরের পাদপদ্মের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ল। তার করুন আর্তনাদে আকাশ বাতাস যেন কেঁদে উঠল। তার আর্তিতে শুধু একটি আবেদন- ঠাকুর দয়াময় তুমি তো সবই জান। তাই তুমি যখন এসেছ, তোমার যখন দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তখন আমার জীবনের অমানিশা আঁধার সত্যিই কেটে যাবে। বেদনায় ভরা করুন মুখখানি আকুতি জানাল ঠাকুরকে - চল প্রানের ঠাকুর, চল মহিয়ান আমার হৃদয়ের ত্রাতা হিসাবে। এসেই যখন পরেছ, সুযোগ দাও তোমার পদধুলিতে আমার অঙ্গন পবিত্র করতে। বধুটির আবেদনে ঠাকুর তার সাথে প্রবেশ করলেন অন্দরে। ভক্তিতে সশ্রদ্ধ বধুটি করজোড়ে নিবেদন করলেন তার দুঃখের কাহিনী, তার সুরাসক্ত উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রহীন স্বামীর কথা। দু-পাঁচ দিনেও ফেরেন না বাড়িতে। যদিও ফেরেন তাও দু-তিন ঘন্টার জন্য। আবার বেরিয়ে যান। ঠাকুর তুমি রক্ষা কর, তুমি বিশ্ব নিয়ন্তা, তুমি সবই পার। শরনাগতিকে আশ্রয় দিয়ে সুপথে চালিত করতে একমাত্র তুমিই পার। বঁধূটির আকুতিতে ঠাকুর উত্তরে বললেন - তাকে আমার কাছে নিয়া এস। সে না আইলে আমি কি করতে পারি?
বঁধূটি কী করবে? স্বামী ত তার কথাই শুনেনা। ঠাকুর বঁধূ টির প্রার্থনা বুঝিয়া মঞ্জুর করলেন। ঘটে গেল এক বিরল অঘটন। বঁধূটিকে সান্ত্বনা আর আশীর্ব্বাদ দিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করলেন। কিছু দূর যেতেই দেখতে পেলেন মাতাল জমিদার পুত্রটি টলতে টলতে অশ্রাব্য কথা বলে এগিয়ে আসছে। কিন্তু যতই ঠাকুরের কাছে আসছে ততই তার বাকরহিত অবস্থা। সামনে এসে লুটিয়ে পড়লেন ঠাকুরের পাদপদ্মে। একী বিস্ময়! ঠাকুরের বুড়ো আঙুলে মুখ রেখে পরম তৃপ্তিতে চুষতে লাগল। তার চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু বইতে লাগল।
ঠাকুর বলছেন - খা আরো খা এমন মদ আর পাবি না। স্নেহ বরিসনে অমৃত ধারা ঠাকুরের প্রাণে বইতে লাগল। জমিদার পুত্র ধৈন্য হল।
তখনও মাতাল ঠাকুরের পায়ের আঙুল চুষে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঠাকুর তাকে নিজ হাতে তুলে ধরেছেন। ততক্ষণে তার নেশা কেটে গেছে। অবাক বিস্ময়ে ঠাকুরের পায়ের দিকে চেয়ে জমিদার পুত্র বিমোহিত। তার চোখ বেয়ে জল পড়ছে।
ঠাকুর বললেন - বাড়ি ফিরা যান। স্ত্রীরে সম্মান করবেন। ভালোভাবে চলবেন।
মাতাল জমিদার ফিরে এল ঘরে। বিস্ময় ঘোরে সে তখনো আবিষ্ঠ। স্ত্রীর কাছে ঠাকুরের কথা শুনে লজ্জায় ঘৃণায় নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে ভক্তির ভাবে আপ্লুত হয়ে গেল তার মন। তার চোখে শুধু ঠাকুরের পাদপদ্ম। তার স্মৃতিতে শুধু ঠাকুরের পায়ের আঙুল চুষা। সেই তার চরম নেশা। ঠাকুরের অশেষ কৃপা না থাকলে এমন হতে পারে না। তার স্ত্রী অতি ভাগ্যবতী আর পতী পরায়না হওয়াতে স্বামীকে কুপথ বর্জনে এভাবে গুরু চরণে নিজেকে সমর্পণ করেছিল।
তাই স্বামী-স্ত্রী দু-জন মিলে আবার হাজির হল ঠাকুরের পাদপদ্মে। ঠাকুর দয়া পরবশ হয়ে দিলেন নাম। সেই নামের ধারায় নিমজ্জিত হয়ে ফিরে এলেন নতুন জীবনে। উত্তরণের পথ ধরে এগিয়ে এলেন পঙ্কিল পথ ছেড়ে নব পথে গুরু মহিমায়।

~ পরমেষ্ঠী গুরু শ্রীশ্রী রামঠাকুর
ডঃ প্রশান্ত কুমার ভট্টাচার্য
পৃষ্ঠা: ৩৯৫

রবিবার, ১২ জুলাই, ২০১৫

শ্রীশ্রী রামঠাকুর শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ। তাঁকে উদ্দেশ্য করে শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ পূজা করলে তাঁর জীবদ্দশায় বা বর্তমানে ও ছদ্মবেশে উপস্থিত হয়ে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করেন। তার একটি প্রমান হলো -
শ্রীশ্রী রামঠাকুর বিক্রমপুরে (বাংলাদেশ) জনৈক ভক্তের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। একদিন তাঁর আশ্রিত শ্রী দিগেন্দ্র নাথ ঘোষাল, শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে তাঁর বাড়িতে শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ পূজায় উপস্থিত থাকতে নিমন্ত্রণ করেন এবং নিজে এসে শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে নিয়ে যাবেন বলে জানান দেন। ইহা শোনে শ্রীশ্রী রামঠাকুর বলেন যে, তাকে আসতে হবেনা না। তিনি নিজেই যেতে পারবেন। ইহা শোনে দিগেন্দ্রবাবু চলে যান এবং শ্রীশ্রী রামঠাকুরের কথা মনে করতে করতে যথাসময়ে পূজার আয়োজন করে শ্রীশ্রী রামঠাকুরের উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এমন সময় এক বৃদ্ধ ভিখারী এসে প্রসাদ পেতে পিড়াপিরি করতে থাকে। তখন ও পূজা হয়নি। তবু দিগেন্দ্রবাবু নিবেদিত ভোগের অগ্রভাগ সরিয়ে রেখে বাকি অংশ দিয়ে সিন্নি তৈরী করে ভক্তি সহকারে ঐ ভিখারীকে দেন। প্রসাদ পেয়ে ভিখারী তৃপ্তি সহকারে চলে যায়। শ্রীশ্রী রামঠাকুর স্বাভাবিক ভাবে ঐ দিন দিগেন্দ্রবাবুর আয়োজিত পূজায় যোগদান করেননি। ফলে দিগেন্দ্রবাবু দুঃখিত হন এবং পরের দিন শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে তাঁর না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে শ্রীশ্রী রামঠাকুর বলেন যে তিনি বৃদ্ধ ভিখারী রূপে শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ পূজায় সিন্নি তৃপ্তি সহকারে গ্রহণ করেছিলেন। ইহা শোনে দিগেন্দ্রবাবু লাঠিবত শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে প্রনাম করে আনন্দিত হন।
এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে শ্রীশ্রী রামঠাকুর শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ পূজায় ছদ্মবেশে উপস্থিত হন। বিনয়ের সহিত শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ প্রসাদ বিতরণ করলে শ্রীশ্রী রামঠাকুর সন্তুষ্ট হন।

শ্রীশ্রী রামঠাকুরের অলৌকিক কার্যকলাপ (দ্বিতীয় খন্ড)
শ্রী হরেকৃষ্ণ পাল
পৃষ্ঠা: ৩৮

শনিবার, ১১ জুলাই, ২০১৫

দীক্ষা নেওয়ার পর নিরামিষ আহার আরম্ভ করিয়াছিলাম। আমার স্ত্রী ঠাকুরকে জানালেন যে আমি নিরামিষ খাইতেছি! ঠাকুর আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন "নিরামিষ খান কেন? বলিলাম "রজঃগুন বৃদ্ধি হয় বলিয়া।" তিনি বলিলেন "শাকেও রজঃগুন বৃদ্ধি হয়, জোর করিয়া কাহাকেও তাড়াইতে হয় না, যার যখন সময় হইব নিজেই ছাইড়া যাইব।" বাস্তবিক মাংসটা ছাড়িয়া গিয়াছে, ইহা বলা যায় দাঁত নাই বলিয়া। কিন্তু মাছ যখন খাইতেছি ডিমের পোচ খাইতে কোনও অসুবিধা হইতে পারে না। কিন্তু ডিম খাওয়ার ইচ্ছাই হয় না।
~ শ্রীশ্রীরামচন্দ্র স্মৃতি কথা। রাজেন্দ্র লাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঠাকুরকে একবার জিগগেস করেছিলাম, নানা বৈষয়িক কার্যে লিপ্ত থাকার জন্য একাগ্রচিত্তে 'নাম' করিতে পারি না - কি উপায়?
- 'আপনে আপিসে যে কাজ করেন, সংসারের জন্য যে কাজ করত্যাছেন, যাকে বৈষয়িক কাজ বলত্যাছেন, এসব কার কাজ? সেইটাও তাঁরই কাজ। সংসার তিনিই সৃষ্টি করছেন, সংসারের কাজগুলিও তা তাঁরই। সব কাজের মধ্য দিয়ে 'তাঁর' চিন্তা করলেই, 'তাঁর' নিকট হইতে নিকটতর হওয়া যায়।' প্রত্যুত্তরে ঠাকুর বললেন।
~ কৃপাসিন্ধু রামঠাকুর। শ্রী মনোরঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
একবার অফিস থেকে আমাকে টেলিগ্রাম সংক্রান্ত কাজের ব্যাপারে কিছুদিনের জন্য Statesman পত্রিকা অফিসে পাঠায়। সেখানে মুসলমান বাবুর্চিরা টিফিন দিত। সে যুগে হিন্দু হয়ে মুসলমানের হাতে জল খাওয়া সমাজের দিক থেকে খুবই গর্হিত কাজ বলে গন্য হতো। আমারও এ ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। দ্বিধাগ্রস্থ মন নিয়ে জিগগেস করলাম ঠাকুরকে। ঠাকুর তখন কালীঘাটে আমাদের বাসায় ছিলেন। আমার সমস্যার কথা শুনে মৃদু হাসলেন এবং সহজ কন্ঠেই বললেন, -'ইহাতে কোন দোষ নাই।' তারপর ধর্মের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা অতি সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন। আমার মনের সংশয় ও দ্বন্দ বিদূরিত হলো। এই প্রসঙ্গে বলি - ঠাকুরের অনেক মুসলমান ধর্মালম্বী ভক্তও ছিলেন। ঠাকুরের ধর্মাচরণের মধ্যে কোনরূপ সাম্প্রদায়িক মনোভাব না থাকার জন্য নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের বহু বিশিষ্ট মুসলমান ধর্মালম্বী মানুষ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা করতেন। সকল জাতি ও ধর্মের মধ্যে তিনি 'সত্য'কে দেখতেন। সেইজন্যই দেখা যায়, বঙ্গ বিভক্ত হওয়ার পরও পূর্ববঙ্গে ঠাকুর সুস্থ পরিবেশের মধ্যেই জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অতিবাহিত করেছিলেন।
~ কৃপাসিন্ধু রামঠাকুর। শ্রী মনোরঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
কবি নবীন চন্দ্র সেন লিখেছেন।....
"...পরসেবায় তাহার পরমানন্দ। জেলখানার ইটখোলার গৃহে পাবলিক উওয়ার্কস প্রভুদের বারাঙ্গনা গণ কখন পালে পালে উপস্থিত হয়। কিন্তু রাম ঠাকুর তাহাদের ঘৃনা করা দূরে থাকুক, বরং সন্তোষের সহিত নিজে রাঁধিয়া তাহাদের অতি যত্নে আহার করায় এবং মাতাল হইয়া পড়িলে তাহাদের আপন মাতা কি ভগিনীর মত শুশ্রুষা করে।...."
১৯০৯-১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে , মহেন্দ্র চক্রবর্তী মশাই (ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র) তখন ঢাকাতে সামান্য মাইনের চাকরি করেন, খুব ছোট ঘরে থাকেন। হঠাত একদিন রামঠাকুর এসে উপস্থিত হলেন তাঁর ঐ ছোট ঘরে - সাথে নিয়ে এসেছেন একখানা মাত্র কাপড় আর একটা ঘটিতে সামান্য তিলের শাঁস। বেশ কিছু দিন মহেন্দ্র চক্রবর্তী মশাইয়ের ছোট ঘরেই কাটিয়ে দিলেন তাঁর "সোনা কাকা।" দিনে কোথায় যেতেন, কি করতেন, তা ছিল মহেন্দ্র বাবুর অজানা, তবে রাত্রে তাঁর বিছানাতেই ঠাকুর শুতেন। এই সময় তিনি মহেন্দ্র চক্রবর্তী মশাইকে সংসার জীবনে অবশ্যই পালনীয় সরল ক'টি উপদেশ দিয়েছিলেন তা হল...
"সর্বদা সত্যপথে থাকিয়া সংসার আশ্রমের কাজগুলি যথাযথভাবে সম্পন্ন করিবে- ইহাই সংসারীর তপস্যা। কাজ কখন ফেলিয়া রাখিবে না। যখন যে কাজ করা আবশ্যক তখনই তাহা করিবে। চাকরি ক্ষেত্রে উপরওয়ালার অনুগত হইয়া চলিবে। সাধ্যমত নিজ কর্তব্য করিবে, সুখে-দুঃখেই মানুষের জীবন চলে, তাহাতে বিচলিত হইবে না..."

শ্রীশ্রী ঠাকুরের এই উপদেশ শুধু মহেন্দ্র বাবুর জন্যই নয়, আমাদের সকলের জন্য সমান প্রযোজ্য।
(শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র চক্রবর্তী রচিত "শ্রীশ্রী রামঠাকুরের জীবন কথা" অবলম্বনে।)
আমার গৃহে যেদিন প্রথম উত্সব অনুষ্ঠিত হয় সেদিন শ্রীশ্রী ঠাকুর উপস্থিত ছিলেন। কীর্ত্তন আরম্ভ হইয়াছে, পূজার সমস্ত উপকরনও জোগাড় হইয়াছে কিন্তু পুজারী পাওয়া যাইতাছে না। ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, "সবই তো ঠিক হয়েছে, পূজা করবে কে?" ঠাকুর বলিলেন, "কেন? আপনে কি পূজা করিতে পারিবেন না?" আমি বলিলাম, "আমি তো ব্রাহ্মন নই, আমার পূজায় ব্রাহ্মন গণ আপত্তি করিবেন, হয়তো তাঁহারা আমার উত্সর্গীকৃত ভোগের প্রসাদ গ্রহণ করিবেন না। " ঠাকুর বলিলেন, "আজ প্রসাদ লইতে যদি কেহ আপত্তি করে, জানিবেন তাহার ভাগ্যে প্রসাদ নাই।" একটু হাসিয়া আবার বলিলেন, "আপনার মন্ত্র জানিবার কোন প্রয়োজন নাই, যেভাবে ভোগ দেন, সেই ভাবেই দিবেন, তার চেয়ে ভালো মন্ত্র আর নাই, পূজায় যাইয়া বসেন, যাহা করিতে হয় আমিই করিব।" পূজা সুষ্ঠু ভাবে সমাধা হইল, কীর্ত্তন প্রায় রাত্রি বারোটা পর্যন্ত চলিয়াছিল। বহু লোকের সমাগম হইয়াছিল, জাতি-ধর্ম্ম-নির্ব্বিশেষে সবাই সানন্দে প্রসাদ গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই দিন হইতে প্রত্যেক বাড়িতে আমিই পূজা করিতাম, আমার অনুপস্থিতিতে ঠাকুরের আশ্রিত অন্য কোন গুরুভ্রাতা পূজা করিতেন।
~শ্রীগুরু শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রীরোহিনী কুমার মজুমদার।
মজঃফরপুরে যে বাড়িতে আমরা ছিলাম সেখানে গৃহস্বামীর অনেক জিনিস ছিল। আমার শয়ন ঘরের দেওয়ালে একখানি ভারী 'তরবারি' ঝুলান ছিল। তরবারিখানিতে মরিচা ধরিয়া আছে। এক রবিবার সকালে এই তরবারিখানি নীচে নামাইয়া বারান্দায় বসিয়া পরিষ্কার করিতেছিলাম। তরবারিখানির ওজন কমপক্ষে সের পাঁচেক হইবে। এই সময় ঠাকুর বেড়াইয়া ফিরিলেন, তরবারিখানি দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "এই তলোয়ারখানা কোথায় পাইলেন?"
এই কথা বলিয়াই তরবারিখানি হাতে লইলেন এবং ঘুরাইতে আরম্ভ করিলেন। একবার বগলের নিচ দিয়ে একবার পায়ের তলা দিয়া লাফাইয়া লাফাইয়া প্রবল বেগে ঘুরাইতে লাগিলেন। ঠাকুরের দৈহিক শক্তি দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইলাম। কিছুক্ষণ পরে থামিয়া ঠাকুর বলিলেন, "এইভাবে অসুর বধ করা হইয়াছে।"আমার শরীরেও বেশ শক্তি ছিল, ঐ তরবারিখানি আমি চার-পাঁচবারের বেশি ঘুরাইতে পারিলাম না।
~শ্রীগুরু শ্রীশ্রী রামঠাকুর
শ্রীরোহিনী কুমার মজুমদার।
শ্রী শ্রী ঠাকুর সকল ধর্মাবলম্বী লোককেই শ্রদ্ধার চোখে দেখিতে আমাদিগকে পুনঃ পুনঃ উপদেশ দিয়াছিলেন। এমন কি সকল জীবের মধ্যেই আত্মা বা প্রাণ শক্তি একই, যদিও বিভিন্ন আবরণে আবৃত হওয়ায় প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন উপাধি ও নাম প্রচার হইয়া থাকে এবং প্রকৃতিও বিভিন্ন হয় বলিয়া তিনি প্রকাশ করিয়াছেন। এমতাবস্থায় কাহাকেও অশ্রদ্ধা করা সম্পূর্ণ ভ্রান্তি। তাঁহার হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ আদি নানা সম্প্রদায়ের ভক্তই আছেন। কিন্তু তিনি কাহাকেও তাঁহাদের নিজ ধর্ম্ম ত্যাগ করিতে বলেন নাই। বরং অনেক সময়েই বলিতেন. 'যার যেই ভাব, সেই সর্ব্বত্তম।' এই সমস্ত নানা কারণেই তিনি সকল ধর্ম্মের লোককেই আকৃষ্ট করিয়াছিলেন। যিনি একবার সশ্রদ্ধ ভাব লইয়া গিয়া অতি অল্প সময়ের জন্যও তাঁহার সান্নিধ্যের সুযোগ পাইয়াছেন, তিনিই তাঁহার প্রতি প্রোগাঢ ভক্তি শ্রদ্ধার ভাব লইয়া আসিয়াছেন। বহু ক্ষেত্রে ইহাই আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা। এই কারণেই সম্ভবতঃ তাঁহার বাত্সরিক জন্ম উত্সবে ও তাঁহার সম্পর্কীয় অন্যান্য অনুষ্ঠানে পাকিস্তান সরকার সকল সময় আমাদিগকে আশাতীত সাহায্য করিয়া আসিতেছেন।
অন্য ধর্মালম্বীর তো কথাই নাই, যাঁহারা ঈশ্বর বিশ্বাসী নহেন বলিয়া লোকে প্রচার করে, তিনি তাঁহাদিগকে নিন্দাসূচক কোন আখ্যা দিতেন না। একদিন আমাদের ঠাকুর ঘরে অনেক লোকের সমক্ষে একজন ভদ্রলোক বলিয়ে ফেলিলেন, যে অমুক লোক একেবারেই নাস্তিক। তাহাতে ঠাকুর বলিলেন, 'নাস্তিক তো ভালই।'

~শ্রী শুভময় দত্ত।
"শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব স্মরণে।"
শ্রী শ্রী ঠাকুরকে তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সম্পর্কে ছোট এক নাতি প্রশ্ন করিয়াছিল, "দাদু, লোকে তোমায় সাধু বলে, তুমি কিরকম সাধু? গায়ে গেরুয়া নাই, মাথায় জটা নাই?'
পৌত্রের কথা শুনিয়া শ্রী শ্রী ঠাকুর হাসিয়া উত্তর দিয়াছিলেন, "আমার ভেকও নাই, ভিক্ষাও নাই।"
~ ছন্নাবতার শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর (পৃষ্ঠা ১৩৮)
একবার শ্রীশ্রী ঠাকুর বাগানের ঘরে বসে আছেন। আমার ছোট ভাই শংকর এক সময় লজেন্স খাচ্ছিল। শ্রীশ্রী ঠাকুরকে একটা লজেন্স দিয়ে বলল, "তুমিও খাও।"সামান্য হেসে সামনে বসানো শ্রীশ্রী ঠাকুরের ছবি দেখিয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুর বললেন, "তুমি ঐখানেই দাও। দেখনা আমার দাঁত নাই, তাই ঐখানেই দাও, তাইলেই আমার খাওয়া হইব। "
কি দয়াল আমাদের শ্রীশ্রী ঠাকুর। কত স্পষ্টভাবে, কত সাধারনভাবে বুঝিয়ে দিলেন, ও ছবি তো শুধুমাত্র ছবি বা পট নয়, জীবন্ত বিগ্রহ, তাতে শ্রীশ্রী ঠাকুর স্বয়ং বিদ্যমান। তাই তো তিনি বললেন, "ঐখানে দাও, তাইলেই আমার খাওয়া হইব।" তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ছবির উল্লেখ করলেন, বোঝালেন আমরা শ্রীশ্রী ঠাকুরকে ছবিতে দেখি, সে ছবি শুধু ছবি নয়, তা যে জীবন্ত, স্বয়ং তিনি বিদ্যমান। আমরা বুঝি না বুঝি, দেখি বা না দেখি শ্রীশ্রী ঠাকুর তাতে স্পষ্টভাবে আছেন। আর তাই শ্রীশ্রী দয়াল ঠাকুর দয়া করে আমাদের এভাবে বুঝিয়ে দিলেন।
~জয় গুরু শ্রীরাম। শ্রী অজিত কুমার সেন।
ঠাকুর পদ্মাসনে বসে আছেন। সাথে ছিলেন জনৈক সেবক। নাম লিখে লিখে একে একে নাম দেওয়া শুরু হল। গুরুদেবের চরণে নাম প্রাপ্তরা ফলমূল ও যা যা সম্ভব গুরু দক্ষিনা দিয়ে পাদস্পর্শ করে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। বাইরে একটি কুকুর ঠান্ডায় বার বারই কেঁদে উঠছিল। নমস্কার করে নাম নিয়ে এক শিষ্য চলে যাচ্ছিলেন। ঠাকুরের হৃদয়ে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হল। তিনি ব্যাগ্র হয়ে একটি চাদর উঠিয়া তার সাথের ভক্তটিকে দিয়ে বললেন - কুকুরের উপর ঢাকনা দিয়ে আস। ঠান্ডায় কষ্ট পাইতাছে।
একজন আশ্রিত বলল - ঠাকুর আপনার শ্রীদেহেও ঠান্ডা লাগছে; এজন্যই আপনাকে এই চাদরটি দেওয়া। আপনি নিজে গায়ে না দিয়ে কুকুরের গায়ে ঢাকনা দিতে বললেন, তাহলে কি আমার গুরুদক্ষিনা আপনি গ্রহণ করলেন না?
ঠাকুর হেসে বললেন - সর্ব জীবেই আমি আছি, আমার আশ্রিত সবাই সমান, তাই কুকুর চাদরটি গায়ে দিলে আমারই গায়ে পরা হবে।
এ কথায় আশ্রিত শিষ্যটি এবার সত্যিই প্রীত হলেন। ঠাকুরকে পুনরায় নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন। চলল নাম দান অনুষ্ঠান সারা দিন এমনকী গভীর রাত পর্যন্ত।